জলু – দ্বিতীয় পর্ব

প্রথম পর্বের পর

শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। এবার, এবার কী করব?

আকস্মিক হতচকিত বাবা এ বার খপ্‌ করে আমার হাত চেপে ধরল, না, ও নামবে না। অ্যাই, তুই বসে থাক, এই যে ভাই, তুমি বলো, তোমার কী বলার আছে, এইটুকুনি ছেলে, তখন থেকে অনেক অভদ্র ব্যবহার করেছো আমার সাথে, তোমার বাবার বয়েসী হই আমি, কী ভেবেছো টা কী?

আকস্মিক প্রতি-আক্রমণে ছেলেটা একটু থতমত খেয়ে গেছিল বোধ হয়, ভারী দল থাকা সত্ত্বেও বেশ মিনমিন করে বলল, ও কেন ঐ ভাবে বলল, ট্রেনে এসেছি? এখানে ভর্তি হতে এসেছে, সিনিয়রদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, জানে না?

বাবা এইবারেও আপার হ্যান্ড নিল, সিনিয়রদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, তুমি জানো সেটা? তুমি আমাদের সাথে এক ট্রেনে এসেছো এনজেপি থেকে, একবার উত্তর দেওয়া হয়েছে আমরা পলিটেকনিকে আসি নি, ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে এসেছি – তারপর দশবার করে জিজ্ঞেস করার মানে কী কীসে এসেছি? তুমি জানো না আমরা কোন ট্রেনে এসেছি? তুমি ছিলে না পাশের বার্থে বসে? … আর তোমাকে আমি চিনি না জানি না, তুমি জিজ্ঞেস করলেই বা আমি উত্তর দেব কেন? কীসের সিনিয়র জুনিয়র দেখাচ্ছো? কতবার বলব যে আমার ছেলে তোমাদের কলেজে ভর্তি হতে আসে নি, এসেছে জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে?

আরেক নেতা এগিয়ে এল, কাকু, আপনি অনেকবার বলেছেন, কিন্তু আপনি বোধ হয় জানেন না, জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ইনটেক অলরেডি শেষ হয়ে গেছে ছদিন আগে, সতেরো তারিখ। আজ চব্বিশ তারিখ। এখন এখানে ইনটেক চলছে, পলিটেকনিকে। আপনার ছেলে পলিটেকনিকেই ভর্তি হতে এসেছে, তাই না? আমাদের তখন থেকে ভুলভাল বলে মিসগাইড করে যাচ্ছেন আপনি।

ওফ্‌ফ্‌, এই কথা? বাবা ছেলেটাকে ডাকলো, শোনো ভাই, তোমার নাম কী? পলিটেকনিকে পড়ছো, খুব স্মার্ট হয়েছো, খুব লজিকালি চিন্তাভাবনা করো বুঝতেই পারছি। তা এত যখন লজিকে গন্ডগোল পেয়েছো, ট্রেনে বসেই আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারো নি? এখানে এসে নিজের দলবল পাশে না পাওয়া পর্যন্ত জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছিল না বুঝি? … এই দ্যাখো ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের প্রস্পেক্টাস, এই হল ভর্তির ফর্ম, এই হল প্রিন্সিপালের চিঠি, এর চোখের অপারেশন হয়েছিল, তাই এর স্পেশাল কেসে লেট অ্যাডমিশন।

চিঠি অবধি যেতে হল না। ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের প্রস্পেক্টাস দেখামাত্র নেতার চোয়াল ঝুলে পড়ল, দলটা পাতলা হতে শুরু করল, এবং অস্ফুটে খিস্তি, একে অপরকে; ‘আবে তুই কেন … ,’ ‘তুইই তো …’।

এ বার ওয়াইন্ড আপ। আরেক নেতা এগিয়ে এল, সরি কাকু, ভুল হয়ে গেছে, আসলে আমরা ভেবেছিলাম … ইত্যাদি, আপনি চলে যান, এই রাস্তা, অ্যাই রিক্সা, নিয়ে যা। তারপর ভিড়ের উদ্দেশ্যে: এই তোরা ছেড়ে দে, এরা ফুলপ্যান্টের লোক।

রিক্সা এগলো ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের দিকে, ফাঁকা জায়গা পেয়ে বাবা আমাকে প্রচন্ড ধমক লাগাল, নতুন জায়গায় এসে কেউ এ রকম ট্যারা ট্যারা উত্তর দেয়? বাজে ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছিলি আরেকটু হলে।

একটা ছোট্টো খালের ওপর কালভার্ট, পরে জেনেছিলাম, ওটাও নাকি একটা নদী, নদীর নাম রুকরুকা, পেরোতেই সামনে পড়ল একটা বিশাল বড় সাদা রংয়ের বিল্ডিং। জলপাইগুড়ি সরকারী ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ। এই কলেজ আর পলিটেকনিক এক বিশা-আ-আ-আ-ল এলাকা জুড়ে একই বাউন্ডারির মধ্যে পড়ে। যদিও দুটো সম্পূর্ণ আলাদা সংস্থান। কারুর সাথে কারুর কোনও যোগ নেই।

রিক্সা এগিয়ে চলল। সাদা বিল্ডিং দু হাত বাড়িয়ে বলল, ওয়েলকাম টু জলপাইগুড়ি।

JPE/Jalpaiguri Road Railway Station Map/Atlas NFR/Northeast Frontier Zone -  Railway Enquiry


যদিও শুরু করেছিলাম এই বলে যে, ধারাবাহিকভাবে কিছু লিখব না, তবুও শুরু থেকে এতখানি পর্যন্ত প্রচন্ডভাবেই ধারাবাহিক হয়ে গেল, খাওয়ার পর শোওয়া, দাঁত মাজার পরে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার মত। আসলে এক ধরণের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে আসার পর নতুন জীবনে যাবার ট্র্যানজিশনটা এত বেশি ঘটনাবহুল মনে হয় নিজের কাছে, যে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের দিকে মন চলে যায়। জলপাইগুড়িতে চার বছর কাটানোর প্রতিটা দিন আর আলাদা করে মনে নেই, কিন্তু ঐ শুরুর দিন ক’টা ভীষণভাবে মনে আছে।

চোখের অপারেশনের জন্য সত্যিই জেনারেল অ্যাডমিশনের সাত দিন পরে আমার অ্যাডমিশন হয়, এই তথ্যে কোনও গুপি ছিল না, কিন্তু এর ফলে একটা ব্যাপক ব্যাপার হয়েছিল, সেটা ভালো না খারাপ হয়েছিল জানি না, অন্তত তখনকার মত, আমার খুব আশীর্বাদ হিসেবেই মনে হয়েছিল ব্যাপারটা, সেটা হল, সম্পূর্ণ র‌্যাগিং পিরিয়ড কেটে যাবার পর আমি হস্টেলে ঢুকেছিলাম। আমি যেদিন হস্টেলে ঢুকলাম, তার ঠিক আগের দিনই মাস্‌ র‌্যাগিং শেষ হয়ে ফ্রেশার্স ওয়েলকাম হয়ে গেছে। ফলে প্রতিটা জুনিয়রের দিকে আর সিনিয়রদের কড়া নজর ছিল না সেদিন থেকেই। এমতাবস্থায় আমার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে নির্দিষ্ট বেডে আমি পৌঁছলাম। জে সি বোস হল, ওরফে হস্টেল টু, ফ্রন্ট উইং, রুম নম্বর থ্রি।

সবেমাত্র রুম খুঁজে হোল্ডঅল খুলে তোষক বের করে পেতেছি টিনের খাটে, আবিষ্কার করেছি তাতে বসলে উঠলে ঘটাং ঘটাং করে বিকট শব্দ হয়, তখন বেলা দশটা, হস্টেল মোটামুটি ফাঁকা, সবাই কলেজে, কেবল ফার্স্ট ইয়ারের সদ্য ইনটেক নেওয়া ছেলেরা রয়েছে, আমাদের ক্লাস তখনও শুরু হয় নি। হ্যাঁ, ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে অ্যাডমিশন হয় না, হয় ‘ইনটেক’। ছোট ঘর, রুমমেট তিনজন, আমাকে নিয়ে চার, তাদের সাথে আলাপ করলাম। আমার খাট জানলার ধারে, করিডরের দিকের জানলা, সেই জানলা ভর্তি হয়ে আছে অজস্র অচেনা মুখে, আর প্রায় চেঁচামেচির পর্যায়ে চলে যাওয়া একটা সম্মিলিত ফিসফাস, ‘ছানা এস্‌চে, নতুন ছানা এস্‌চে’। খাটের ওপর সব শুনেও কিছুই শুনতে পাচ্ছি না এবং কিছুই-বুঝতে-পারছি-না (এটা সত্যিই, আমাকে ছানা বলছে এটুকু বুঝছিলাম, কিন্তু ছানা কেন বলছে সেইটা বুঝি নি) মত মুখ করে বসে আছি আমি আর বাবা। বাবা ট্রাঙ্কের চাবি আমার পৈতেয় বেঁধে দিয়েছে (তখনও পৈতে পরতাম), ঘরের লকারে আমার জায়গা মিলে গেছে, এমন সময়ে …

পুরো হুহুঙ্কারে হাসি-সমেত ‘কইকইকই কোথায় ছানা কোথায় ছানা, দেখি দেখি …’ বলে উড়তে উড়তে লাফাতে লাফাতে যে ছেলেটি এসে ঢুকল আমাদের সামনে, সত্যি বলতে তাকে দেখে আমার প্রচন্ড হাসিই পেয়ে গেছিল। হেসেছিলাম কিনা, এখন আমার মনে নেই, তবে মনে হয় হাসি নি। এক ধরণের মুখ হয় না, দেখলেই পেট থেকে সোডার মত ভুড়ভুড়িয়ে হাসি উঠে আসে, ঠিক সেই রকমের একটা মুখ, মাথায় চুল মোটামুটি হাতে গোনা যায়, পরণে একটা এত্ত ঢোলা ডিপ নীল পায়জামা, যে সেটাকে প্রথম দর্শনে সায়া বলে ভুল হয়, সে ঘরে ঢুকেই আমার সাথে আমার বাবাকে দেখেই থতমত খেয়ে চুপ করে গেল, তার পরেই আমাকে বলল, ‘আরে, তুমি হুগলি থেকে এসেছো না?’

আমি তো অবাক। আমায় কী করে চিনল? ছেলেটাই তখন বলল, ‘মনে আছে, তুমি ব্যান্ডেল সাহাগঞ্জে প্যাথোলজি ল্যাবে এসেছিলে ব্লাড গ্রুপ টেস্ট করতে, আমিও গেছিলাম রিপোর্ট আনতে, তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে যাচ্ছো কিনা?’

এক লহমায় মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, দেখা হয়েছিল বটে। বাঁশবেড়িয়ার ছেলে, পদবী সাধু। প্রচুর কথা বলে গেছিল একতরফা সেই প্যাথোলজি ল্যাবে বসে, আমি স্বভাবে লাজুক, ইন্ট্রোভার্ট, অচেনা লোকের সাথে বেশি কথা বলতে পারি না, ফলে তার মুখের দিকেও তাকাই নি, তার সাথে হুঁ হাঁ-র বেশি কথাও বলি নি, ফলে সে-ও আমাকে জানায় নি যে সে-ও জলপাইগুড়িতে একই কলেজে আসছে ভর্তি হতে। ফলে আমি তাকে মনে রাখারও চেষ্টা করি নি।

সাধুকে দেখলাম সবাই টাকলা টাকলা বলে সম্বোধন করছে। কোনও মানুষের কোনও দুর্বলতা বা ঐ টাইপের কিছুকে নিয়ে মজা করতে নেই, কানাকে যেমন কানা বলতে নেই, খোঁড়াকে খোঁড়া বলতে নেই, এমনটাই শিখে এসেছি ছোটবেলা থেকে, কিন্তু এখানে প্রায় টাক পড়ে যাওয়া এক ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেকে টাকলা বলে ডাকতে শুনে কানে কেমন যেন খচ্‌ করে লাগল। কিন্তু সাধুর দেখলাম কোনও হেলদোল নেই।

সাধুই পুরো আমার দায়িত্ব নিয়ে নিল, ‘কাকু আপনি কোনও চিন্তা করবেন না, আমি আছি, এই যে বরুণ, চন্দননগরের ছেলে, আমরা সবাই আছি, কোনও প্রবলেম হবে না।’

বাবা পুরো হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের হস্টেলে ঢুকে এ রকম ফ্রেন্ডলি অ্যাটমোস্ফিয়ার পাবে, এমন আশা বাবাও করে নি, এবং আমিও বেশ আতুপুতু, সখী সখী টাইপের, লাজুক এবং ইন্ট্রোভার্ট ছেলে, তাকে কী করে হস্টেলের পরিবেশে ছেড়ে আসা যায়, এই ব্যাপারটাও বাবাকে বেশ চাপে রেখেছিল, ফলে টেনশনটা কমল।

সাধু ওরফে টাকলাই আমাকে উইংয়ের সমস্ত ঘরে নিয়ে গিয়ে সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিল। এই হস্টেলের একতলায় দুটো উইং, ফ্রন্ট আর ব্যাক, আমি ফ্রন্ট উইংয়ে। একতলায় কেবল ফার্স্ট ইয়ার থাকে। এক আর দুই, দুটো হস্টেলের একতলায়। সাধু আমাকে ক্যান্টিন দেখাল, মেস দেখাল। তারপর তাদের অনুমতি নিয়েই বাবা আমাকে নিয়ে গেল সার্কিট হাউসে, বিকেলে আবার হস্টেলে ফেরৎ দিয়ে যাবে, এই মর্মে কথা দিয়ে।

সার্কিট হাউসে বুকিং করে রাখাই ছিল। রিক্সা চলল এ বার জলপাইগুড়ি শহরের বুক চিরে। এই প্রথম চারপাশের দিকে মন দেবার সুযোগ পেলাম। যা ঝড়ঝাপটা গেল। আসার সময়ে তো পলিটেকনিকের ছেলেরা ঘিরে ছিল বলে কিচ্ছুটি দেখার সুযোগ পাই নি। এবার চোখ মেলে দেখলাম।

আমরা যারা মূলত দক্ষিণবাংলার ছেলে, তারা সহজেই বুঝতে পারি যে আমাদের চেনা ভূপ্রকৃতি এখানে নেই। এটা অনেকটা আলাদা। রাস্তা পিচেরই, কিন্তু ঠিক হুগলি কলকাতার মত মসৃণ নয়, কেমন একটা খরখরে আনইভন ব্যাপার আছে। রাস্তার দুপাশে ঠিক ধুলো নেই, বড় বড় নুড়িপাথর , প্রায় ধুলোর মত গ্রেনে পরিণত হওয়া, কিন্তু ঠিক আমাদের ওদিককার মত ধুলো নয়। গাছগাছালিও একটু অন্যরকম, চারপাশের বাড়িঘরদোর দোকানপাট সবই কেমন যেন অন্যরকম। বাংলার মধ্যেই, চারদিকে সমস্ত কিছুই বাংলায় লেখা, কিন্তু ঠিক যেন আমার চেনা পরিচিত বাংলা নয়।

পার হয়ে গেলাম একটা কালভার্ট, নিচে একটা খাল, জানলাম এটাই নাকি করলা নদী। এটাই করলা? সমরেশ মজুমদারের লেখায় কত্ত পড়েছি!!

পেরোলাম শান্তিপাড়া, আরো কী কী সব যেন পাড়া। সার্কিট হাউস শহরের আরেক প্রান্তে, তিস্তা নদীর ধারে। তিস্তার দু কূল দেখা যায় না, এত চওড়া। আমাদের গঙ্গাও চওড়া, কিন্তু চুঁচড়োর অন্য পাড়ে নৈহাটি দিব্যি দেখা যায়। যাই হোক, সার্কিট হাউস ঝক্কাস থাকার জায়গা, দুপুরে খেতে বসে দেখি একটা অজানা তরকারি। মুখে দিয়েই ওয়্যাক করে ফেলে দিতে হল, কী ভয়ংকর বিচ্ছিরি জঘন্য জল-জল স্বাদ! বাবাও মুখে তুলল, বলল, ‘হুঁ, সন্দেহ করছি এটা স্কোয়াশ।’ অ্যাটেন্ড্যান্টকে ডাকা হল। সে বিগলিত মুখে জানাল, এটা স্কোয়াশই বটেক।

স্কোয়াশ কী? সে তো দেয়ালের সাথে টেনিস খেলা বলে জানতুম। আর কিসানের অরেঞ্জ স্কোয়াশ লেমন স্কোয়াশ খেয়েছি।

এই স্কোয়াশ একটা ফল বা সব্জি। উত্তরবঙ্গ স্পেশাল। পরে হস্টেল জীবনে বহুবার স্কোয়াশের তরকারির সম্মুখীন হয়েছি, কিন্তু সেই প্রথম দিনের বিভীষিকার ফলে চিরদিনই তাকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে গেছি।

যাই হোক, সেই স্কোয়াশের স্বাদ কাটাবার জন্য গ্লাস থেকে এক চুমুক জল মুখে দিলাম। মাথার চুল এ বার খাড়া হয়ে গেল। কী তীব্র কষা স্বাদ জলের! মুখে দেওয়া যাচ্ছে না! বাবা বলল, ‘পাহাড়ী তরাই এলাকার জল কিনা, এই রকমই হয়। লোহা ভর্তি।’

আমার তখন হয়ে গেছে। এই জল খেয়ে চার বছর কাটাতে হবে? মুখে দেওয়া যাচ্ছে না, এমন কটু স্বাদ। স্কোয়াশকে না হয় বাদ দিয়ে বাঁচা যেতে পারে, কিন্তু জল না খেয়ে থাকব কী করে?

বিকেলে আবার হস্টেলে ফিরে এসেছিলাম। পরদিন দুপুরেই বাবার চলে যাবার কথা। প্রথম রাত কাটলো হস্টেলে। নির্বিঘ্নেই। এত নির্ঝঞ্ঝাট হস্টেল লাইফের শুরুয়াৎ বোধ হয় আর কারুর জীবনে হয় নি। বন্ধুদের সাথে পরিচয় হতে হতেই সন্ধে কেটে গেল।

সে না হয় হল। কিন্তু বাবার মন কি আর মানে? সদ্য সাবালক ছেলে না জানি কত মার খেয়ে পড়ে আছে হস্টেলে, সেই আশঙ্কায় সারা রাত ঘুমোয় নি বাবা, চোখেমুখে স্পষ্ট সেই উদ্বেগ দেখলাম যখন পরদিন সকাল সাতটায় বাবা এসে হাজির হল।

কলেজের মোড়ে সারি সারি গুমটির দোকান, পাঁউরুটি ঘুগনি ডিমভাজার দোকান, সাইকেলের পাংচার সারাইয়ের দোকান, ফোন বুথ। একটা গুমটির দোকানে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বসলাম রাস্তার ধারের একটা খালি বেঞ্চিতে। আপ্রাণ চেষ্টা, বড় হয়ে গেছি, চোখ দিয়ে যেন একফোঁটাও জল না বেরিয়ে যায়, তবু চোখ বাগ মানছে না, মনে হচ্ছে বাবার হাত ধরে একটু কেঁদে বলি, বাবা, আমি এখানে থাকব না, আমাকে নিয়ে চলো। জীবনে প্রথম একা অচেনা জায়গাতে থাকার যে কী চাপ, কী চাপ! সেই আঠেরো বছর বয়েসে। বাড়ি থেকে এত্ত দূর, চাইলেই বাড়ি ফেরার কোনও উপায় নেই, থাকতেই হবে এখানে।

চুপচাপ বসে থেকে দুটো ঘন্টা কেটে গেল। এক সময়ে দুপুর হল, ওখান থেকেই রিক্সা নিয়ে জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে চলে গেলাম বাবাকে পৌঁছে দিতে। আবার খানিক অপেক্ষা। তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে এল। ফিঙে পাখির ল্যাজওলা লালনীল সিগনাল আস্তে করে নেমে গেল। বাবা হাত নেড়ে উঠে পড়ল ট্রেনে। আমি পড়ে রইলাম জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে। একা।

খানিক পরে, আরেকটা রিক্সা ধরে ফিরে এলাম হস্টেলে।

নতুন জীবনের শুরু।

… চলবে


মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.