জলু – পঞ্চম পর্ব

চতুর্থ পর্বের পর

প্রথম দফায় হস্টেলে ছিলাম একুশ বা তেইশ দিন, কিন্তু তাইই মনে হচ্ছিল তেইশ মাসের সামিল। তারই মধ্যে প্রচুর হইহল্লা করে কেটে গেল দিনগুলো। কলেজের ভেতরটা ঘুরে দেখার আগেই চলে এল মাস ডামার দিন।

মাস ডামার গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং, জলপাইগুড়ির সেই সময়কার ট্র্যাডিশন ছিল এটা। বড় ধরণের কোনও ছুটি, যেমন পুজোর ছুটি বা গরমের ছুটির আগে কলেজ থেকে স্টুডেন্ট কনসেশন ফর্ম দেওয়া হত সবাইকে। হোমটাউন পর্যন্ত ট্রেন ভাড়ায় পঞ্চাশ পার্সেন্ট ছাড়। মানে, স্লীপার ক্লাসে দুশো টাকা যদি ভাড়া হয় জলপাইগুড়ি রোড টু ব্যান্ডেল, তো সেটা একশো টাকায় পাওয়া যেত। এক ভদ্রলোক ছিলেন, এতদিনে তাঁর নাম ভুলে গেছি – তিনি প্রত্যেকের নামে একটা করে ফর্ম ভরে দিতেন, সেই ফর্ম স্টেশনে গিয়ে দেখালে কনসেশনের টিকিট পাওয়া যেত।

যে সময়ের কথা বলছি, তখনও ইন্টারনেট পরজন্মের কথা, কম্পিউটারে চলত কেবলমাত্র ডস অপারেটিং সিস্টেম, কম্পিউটারাইজ্‌ড রিজার্ভেশন সম্ভবত এক্সিস্টও করত না তখন। কেবলমাত্র শিয়ালদা বা হাওড়া স্টেশন জাতীয় মহানাগরিক এলিট ক্লাসের স্টেশন থেকে কম্পিউটারাইজড টিকিট পাওয়া যেত। এক প্ল্যাটফর্মওয়ালা জলপাইগুড়ি রোডে কী করে থাকবে সে সব ফেসিলিটি? সেখানে চলত কোটা সিস্টেম। তিস্তা তোর্সা আর কামরূপের একটা দুটো কোচের কিছু সিট জলপাইগুড়ি রোডের নামে বরাদ্দ থাকত, যে দিন ফিলআপ হয়ে যেত তো যেত, না হলে খালি সিট নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে গিয়ে আরএসি ইত্যাদিদের অ্যালট করে দেওয়া হত। তো, জনতা দল বেঁধে রোড স্টেশনে গিয়ে সেই রিজার্ভেশন করিয়ে আসত।

এই গল্পটা শুধু জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনের নয়, এদিকেও তাইই ছিল। ব্যান্ডেল নৈহাটি ইত্যাদি জংশন স্টেশনে কামরূপ, তিস্তা-তোর্সা, দার্জিলিং মেল ইত্যাদি ট্রেনের ‘কোটা’ থাকত। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ফর্ম ভরে আমরা পেপার টিকিট পেতাম, হাতে লেখা।

ফিরে আসি কলেজের সেই কনসেশন ফর্মে। একটাই ফর্ম হত, যাওয়া এবং ফিরে আসার জন্য। যে ভদ্রলোক ফর্মগুলো ইস্যু করতেন, ওয়ার্কশপ ইন্সট্রাক্‌টর, তিনি বেশ দয়ালু প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন। ছাত্রদরদী। পুরো ফর্মটা লিখতেন চেলপার্কের সবুজ রংয়ের কালিতে। নো ডটপেন। ডটপেন তখন প্রচলিত হলেও কালিপেনও চলত। ছাত্রদের কেবল কাজ ছিল নিজেদের সুবিধের জন্য চেলপার্কের একই রংয়ের আরেকটা কালির শিশি কিনে আনা, একটা কালি-পেন, জনসনের ইয়ার বাড, অভাবে তুলো, আর এক শিশি জিওলিন; এই কটা জিনিস নিজেদের পজেশনে রাখা।

ফর্ম ভর্তি হয়ে চলে এলে হস্টেলে কাজে নেমে পড়ত শিল্পীরা। আমিও এই শিল্পকর্মে নিযুক্ত থেকেছি অনেকদিন। শিল্পটা আর কিছুই না, একটা দেশলাই কাঠির ডগায় অল্প একটু তুলো লাগিয়ে, সেই তুলো জিওলিনে ভিজিয়ে সুক্ষ্ম হাতে যাওয়া এবং আসার তারিখদুটোকে মুছে দেওয়া। সবুজ কালি উঠে গিয়ে জায়গা দুটো ক্লোরিনের কল্যাণে একেবারে কোরা কাগজ হয়ে যেত। এইবার নিজেদের সবুজ কালিতে, সেই ভদ্রলোকের হাতের লেখার স্টাইলে নিজেদের পছন্দমত ডেট বসানো হত। সাধারণত পুজোর ছুটি পড়ত মহালয়ার দিন থেকে, থাকত ভাইফোঁটা পর্যন্ত। আমরা সেটাকে বাড়িয়ে নিতাম আগে পিছে এক থেকে দু সপ্তাহ মতন। মোটামুটি মহালয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকেই হস্টেল ফাঁকা হয়ে যেত, আবার ভর্তি হত ভাইফোঁটার পরের সোমবার। অনিচ্ছুক হবার কারুর উপায়ও ছিল না, কারণ মেজরিটি চলে যাবার ফলে মেস টেসও বন্ধ হয়ে যেত। বাইরে একদিন দু দিন খাওয়া যেত, কিন্তু দীর্ঘদিন বাইরে খাওয়া ছাত্রদের পক্ষে বেশ অসুবিধাজনক ছিল। ফলে, সেই বিশেষ দিনটিতে প্রায় দেড়শো দুশো ছাত্র একসাথে ট্রেনে চড়ত।

কথায় বলে একতাই শক্তি। এতগুলো ইয়ুথ যখন একটা ট্রেনের কামরায় উঠে পড়ে, তখন টিকিট কাটার আর কী দরকার? কে কী করবে? অতএব, জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে খালি একটা জেনারেল কম্পার্টমেন্ট বেছে পুরো দলটা উঠে পড়ত সেখানে। সিট, ওপরের বাঙ্ক, নিচের মেঝে সর্বত্রই সেদিন জলু কলেজের ছাত্রয় ছয়লাপ। শোবার জায়গা কারুরই হত না, তবে বসার জায়গা জুটে যেত। চোদ্দ ঘন্টার জার্নিতে শোবার খুব একটা দরকার হত না, কারণ, বাড়িতেই তো যাচ্ছি, অঢেল আরাম পাবো সেখানে, একটা রাত্তির না হয় কষ্ট করলাম।

এই দল বেঁধে বিনা টিকিটে যাওয়াটাকেই বলা হত মাস ডামা। অনেক সময়ে পাঁচজনে মিলেও ডামা করেছি, কিংবা হাফ ডামা। গাঁট হত মালদায়। সেখানে প্রায় চল্লিশ মিনিটের স্টপেজ ছিল। স্পেশালি জেনারেল কম্পার্টমেন্টেই গুছিয়ে চেকিং হত। একসাথে দেড়শো দুশো বিনা টিকিটের ছাত্রের সামনে বীরত্ব দেখানোর ক্ষমতা ভারতের কোনও টিকিট চেকারের নেই। অতএব, মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং। পারহেড দু টাকা পাঁচ টাকা করে দিলে দেড়শো জন ছেলেপুলের দলে একটা বিপুল পরিমাণের পয়সা জমা হত, সেটা চেকারকে দিয়ে দেওয়া হত, চেকারও সৎভাবে আর আগে কোথাও চুকলি কাটত না। এই নিগোশিয়েশনটা করত এক্সপিরিয়েন্সড ছেলেপুলেরাই, আমরা বাকিরা ছিলম আজ্ঞাবহ দাসমাত্র। চাওয়ামাত্র দুটাকা দিয়ে দিতাম।

কাটোয়া নবদ্বীপধাম ব্যান্ডেল নৈহাটি, আলটিমেটলি হাওড়া বা শিয়ালদা পর্যন্ত এইভাবেই দল বেঁধে সবাই যেত, তারপর যে কোনও স্টেশন থেকে বেরোবার তো হাজারটা রাস্তা আছে! হাওড়া বা শিয়ালদার মত গাঁটের ক্ষেত্রে পাব্লিক লিলুয়া কিংবা বিধাননগর / দমদমে নেমে পড়ত, ট্রেন আগের স্টেশনে থামতই। কোনও অসুবিধা হত না।

আমার প্রথম ডামার অভিজ্ঞতা? নিতান্তই কুল। প্রচন্ড নার্ভাস আর টেন্‌স্‌ড লাগছিল, কারণ তার আগে জীবনে কোনওদিন বিনা টিকিটে এত লং জার্নি করি নি, কিন্তু সঙ্গে অত ছেলে বিনা টিকিটেই যাচ্ছিল, যা হয় হবে সবার হবে, আমি একা তো নই, এই ভাবনাটাই মনে সাহস যোগাচ্ছিল। আলটিমেটলি মালদা কেন, কোথাওই টিটি আসে নি। ব্যান্ডেলে পৌঁছে দিব্যি লাইন পেরিয়ে উল্টোদিক দিয়ে নেমে গেছিলাম রাস্তায়। বিনা পয়সায় বাড়ি, জলপাইগুড়ি থেকে।

অপরাধবোধ? হ্যাঁ … না … মনে কোথাও যে কোনও খিঁচ কখনও ধরে নি তা বলব না, কিন্তু অতগুলো পয়সা বাঁচার সওয়াল যেখানে, একশো টাকা অনেক টাকা, ঐ পয়সায় অনেকগুলো ক্যাসেট হয়ে যায় একবার সিম্ফনিতে গিয়ে পড়তে পারলে, তখন আর ঐ সব অপরাধবোধগুলোকে পাত্তা না দিলেও চলত। আমরা কেউই দিই নি।

আবার কেউ কেউ দিতও। রিলিজিয়াসলি যতবার বাড়ি গেছে এসেছে, প্রত্যেকবার টিকিট কেটেই গেছে, কখনও বিনা পয়সায় ট্রেনে চাপে নি, বিবেকের কাছে তারা সত্যিই খুব পরিষ্কার ছিল, আমরা ছিলাম না। যদ্দূর মনে পড়ে আমাদেরই উইংয়ের ‘বরফমেসো’ – কোনওদিন বিনা টিকিটে যায় নি বা আসে নি। তবে তাতে বন্ধুত্ব নষ্ট হয় নি, বা এর বেসিসে কোনও লবিবাজিরও সৃষ্টি হয় নি।

tank20er20upor20hote
জলু ক্যাম্পাস, এখন যে রকম। সন্ধ্যের মুখে। একদম সামনে হস্টেল টু, এইখানেই কেটেছে আমার তিন বছর। ডানদিকে অর্ধেক কেটে গেছে হস্টেল ওয়ান, দূরে বাঁদিকে ফোর্থ ইয়ার হস্টেল। পেছনে চা-বাগান। এক নম্বর হস্টেলের পেছনে এখন আরেকটা হস্টেল হয়েছে, পুরো ফার্স্ট ইয়ার নাকি এখন ওখানেই থাকে। র‍্যাগিং আর হয় না।

ফার্স্ট ইয়ারে আমার রুমমেট ছিল বৌদি। বৌদি অবশ্যই নিকনেম। আসল নাম টাম নিয়ে এতদিন বাদে আর নাড়াঘাঁটা না করাই ভালো। মধুও ছিল রুমমেট। মধু আদতে তেলুগু, কিন্তু জন্ম পড়াশোনা সমস্তই চিত্তরঞ্জনে, ফলে একেবারে যে কোনও বাঙালির মতই বাংলা বলতে পড়তে ও লিখতে পারত। বেশ ভালো ছেলে, কেবল তিরুপতিকে নিয়ে কোনও রকম খিল্লি পছন্দ করতে পারত না। খুব তিরুপতির ভক্ত ছিল। ফার্স্ট ইয়ারেই পুজোর ছুটির পর মধু ন্যাড়া হয়ে এসেছিল, তাইতে আমাদের এক পাব্লিক কেবল বলেছিল, কী রে, তিরুপতির কাছে বাল দিয়ে এলি নাকি? মধু সেই পাব্লিককে কেবল মারতে বাকি রেখেছিল।

যাক গে, হচ্ছিল বৌদির কথা। কিন্তু তার আগে মধুর নামে আরও একটা কথা। মধু বেশ ভালো মাউথ অর্গ্যান বাজাত। আমরা সবাই শুনতাম। বৌদি ছিল প্রচন্ড ঘোষু ছেলে। দিনরাত হাফপ্যান্ট পরে ঘষত, আর পৈতে দিয়ে গা চুলকোত।  (প্রচন্ড এন্থু নিয়ে পড়াশোনার যাদবপুর শিবপুরে সিনোনিম ছিল/আছে ‘গাঁতানো’; আর সেটাই জলপাইগুড়িতে পরিচিত ছিল ‘ঘষা’ নামে। প্রচন্ড পড়াশোনা করা পাব্লিককে ঘোষু বলে ডাকা হত।)

তো, ঘষাঘষির ফাঁকে ফাঁকে মধুর মাউথ অর্গ্যান শুনে বৌদির খুব ভালো লেগে গেল। এবং সে মধুকে ধরে বসল, তাকে মাউথ অর্গ্যান শেখাতে হবে। বৌদি একাই এ রকমের দাবিদার ছিল না, আরও অনেকেই এ রকম দাবিদাওয়া করেছিল, এবং দু চারবার ফুঁ দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বৌদি মধুকে ছাড়ল না।

একদিন বিকেলে বসে বসে মধুর কাছে মাউথ অর্গ্যান বাজানোর বেসিক ব্যাপারগুলো শিখল বৌদি। সা রে গা মা বাজানো এটসেটরা। রাতে খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে পরে, মধুর মাউথ অর্গ্যানটা নিয়ে বৌদি চলে গেল কমন রুমে। সেখানে সারারাত টেবিল টেনিসের লে-ঠকাঠক দে-ঠকাঠক আর ক্যারমের খটখটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এক কোণে বসে সে মাউথ অর্গ্যান প্র্যাকটিস করা শুরু করল।

আমরা অ্যাজ ইউজুয়াল আড্ডা ফাড্ডা মেরে শুয়ে পড়লাম অনেক রাতে যখন, তখনও কমন রুম থেকে বৌদির রেওয়াজের প্যাঁ পোঁ ভেসে আসছিল। পরদিন সকালে উঠলাম যখন, পাশের বেডে দেখলাম বৌদি বসে আছে, চোখে মুখে রাত জাগার ছাপ স্পষ্ট, এবং মুখের মাউথ অর্গ্যানে অলমোস্ট নির্ভুল সুরে “হ্যায় অপনা দিল তো আওয়ারা’-র সেই টিউন। … এক রাত, মাত্র এক রাতে বৌদি তুলে ফেলেছিল মাউথ অর্গ্যানের পুরো বেসিক্‌স। নির্ভুলভাবে। একা একা।

বৌদির সারাবছরের অত ঘষার কারণটা বোঝা গেছিল পরে। হস্টেলে থেকেই প্রিপারেশন নিয়ে আবার জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিল, এবং এ বারে একটা ঘ্যামা র‌্যাঙ্ক করে কল্যাণীর ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে চলে গেল পরের বছর ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকম ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার জন্য। একটা বছর নষ্ট হল বটে, কিন্তু মনের মত স্ট্রীম তো পেয়ে গেল! আমাদের বছরেই কল্যাণীতে ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ চালু হয়েছিল। বোধ হয় চারশো সিট ছিল সেখানে – আমাদের সময়ে জয়েন্টের লিস্ট বেরোত দু হাজার পর্যন্ত, সে বছর সেটা বেড়ে হল দু হাজার চারশো।

বৌদি এখন একটা খুব নামকরা বহুজাতিক সংস্থায় আছে। এদেশে না বিদেশে, জানি না। শেষ দেখা হয়েছিল আকস্মিকভাবে, নয়ডায়। আমি তখন নতুন চাকরি বদলে সদ্য দিল্লিতে এসেছি, বাড়ি খুঁজছি পাগলের মত, হঠাৎ একটা বাঙালি মিষ্টির দোকানের সামনে বৌদির সাথে দেখা। সে-ও নয়ডাতেই একটা কোম্পানিতে চাকরি করত। তার কয়েক মাসের মধ্যেই বৌদির বড় চাকরিতে জয়েন করার খবর শুনলাম, বৌদি নয়ডা ছেড়ে চলে গেল ব্যাঙ্গালোরে। তারপরে আর যোগাযোগ ঘটে নি।

kuasha20makha20sokal
শীতের সকাল। কুয়াশার চাদরে মোড়া ফোর্থ ইয়ার হস্টেল।

সাধু ছিল টোটাল মজাদার ছেলে। অর্ধেক কথা নাক দিয়ে বেরোত, বাকি অর্ধেক মুখ দিয়ে। আগেই বলেছিলাম তার বৈশিষ্ট্য ছিল প্রচন্ড ঢোলা একটা পায়জামা, গাঢ় নীল রঙের। দূর থেকে দেখলে মনে হত বুঝি একটা সায়া পরে চলাফেরা করছে।

আমি ছিলাম জন্ম আঁতেল। দু চার পীস সুনীল সমরেশ পড়ে ফেলার দৌলতে, আর জীবনমুখী গান গাইবার সুবাদে ততদিনে আমি কলেজের ম্যাগাজিন কমিটিতে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলাম। আমার ওপর গুরুদায়িত্ব পড়েছিল ফার্স্ট ইয়ারের কাছ থেকে লেখা কালেকশন করে ফোর্থ ইয়ারকে পৌঁছে দেবার।

একদিন রোববার দুপুরে, কমনরুমে বসে টিভি দেখছি, সাধু এসে ধরল আমাকে। কী ব্যাপার? “জিনু, আমি একখানা কবিতা লিখেছি, ম্যাগাজিনের জন্য দিতে চাই। আমি তো আসলে খুব একটা লিখি টিখি না, তুই যদি একবার পড়ে বলিস, কেমন হয়েছে, তা হলে লেখাটা তোকে দিই। তুই তো ম্যাগাজিন কমিটিতে আছিস … ইত্যাদি ইত্যাদি।”

সাধু খুব সিরিয়াস আর নাছোড়বান্দা ছিল, অতএব ওকে অ্যাপো দিতেই হল, রাত দেড়টায়, আমার রুমে।

ঠিক সময়ে সাধু হাজির হল, সায়ার পকেটে একটা ভাঁজ করা কাগজ নিয়ে, লাজুক মুখে। কাগজটা খুলে দেখেই বিষম খেলাম। কবিতার নাম, ‘ঝাঁট’।

পুরোটা পড়ে দেখলাম, না, অশ্লীল টশ্লীল কিছু নয়। বেশ সমাজ সচেতনতামূলক। মোদ্দা জিস্ট এই, ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকে প্ল্যাটফর্মে, বাচ্চা ছেলেটা ছেঁড়া জামাকাপড় পরে কামরা ঝাঁট দেয়, নোংরা চেহারা, কেউ তার দিকে ছুঁড়ে দেয় পঞ্চাশ পয়সা, দশ পয়সা, কেউ বা কিছুই দেয় না অবজ্ঞা ছাড়া, কিন্তু সেই ছেলেটা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে চলে আমাদের ময়লা। এমনি করেই একদিন ট্রেন গিয়ে পৌঁছয় আরেক স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, সমাজ তাকে ঝাঁট দিয়ে ফেলে দেয় ট্রেনের বাইরে, … এই রকম।

দুঃখের বিষয়, সাধুর সেই কবিতা ছাপানো যায় নি ম্যাগাজিনে। সেই ক্ষোভেই কিনা, কে জানে, সাধু জলপাইগুড়ি ছেড়ে চলে গেছিল পরের বছর, দুর্গাপুরে, জয়েন্টে দ্বিতীয়বার ভালো র‌্যাঙ্ক করে। আমরা, ভুলভাল ছেলেপুলেরা রয়ে গেলাম জলুতেই ইঞ্জিনীয়ারিং শেষ করার জন্য।


4 thoughts on “জলু – পঞ্চম পর্ব

    1. গুড প্রশ্ন। খেয়াল করি নি এই কনফিউশনটা।

      একসাথে একশো দেড়শো ছেলে উঠত জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে। সেখানে টিকিট কাটার কোনও ব্যাপারই থাকত না। কিন্তু ফেরার সময়ে তো ঐভাবে একসাথে কেউ উঠত না, কেউ হাওড়া থেকে, কেউ নৈহাটি, কেউ শিয়ালদা, ব্যান্ডেল, কাটোয়া, নবদ্বীপ, কালনা, ফারাক্কা – বিভিন্ন জায়গা থেকে উঠত, ফলে ফেরার সময়ে বিনা টিকিট হত না। আমার কনসেশনটা ব্যান্ডেল স্টেশনেই কাজে লাগত, ফেরার টিকিট কাটার জন্য।

      Like

    2. আর ডেট বদলানোর কারণ ছিল, অফিশিয়ালি কলেজ খুলত ভাইফোঁটার পরের দিন, কিন্তু একবার বাড়ি গেলে কি আর কেউ ফেরে? আমরা দলবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে জলুতে ফিরতাম ভাইফোঁটার পরেও এক দু সপ্তাহ কাটিয়ে। তাই কনসেশন ফর্মে ডেট বদলাতে হত।

      Like

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.