
আলাপ পরিচিতির পরিধিটা আরও বাড়ল পুজোর পর যখন বাড়ি থেকে আবার হস্টেলে ফিরে এলাম। আগের বারে হস্টেলে থেকে বাড়ির জন্য মন কাঁদছিল, পুজোর ছুটিতে বাড়িতে থেকে আস্তে আস্তে বুঝলাম অর্ধেকটা মন হস্টেলেই ফেলে এসেছি, ওখানে না ফিরলে আবার সেই পরিবেশ ফেরৎ পাওয়া যাচ্ছে না।
নভেম্বরের গোড়ায় যখন ফিরে এলাম, তখন বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। স্টেশন থেকে কলেজ ক্যাম্পাসের দিকে রিক্শা এগোচ্ছে, আর আমরা হাঁ করে চেয়ে আছি উত্তর আকাশের পানে, সেখানে তখন আত্মপ্রকাশ করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ। আর কিছুদিন পরেই যা আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে। দ্বিতীয়বারের জন্য এই আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে ঢোকা, ভয়হীনভাবে প্রথমবার। এখন সবাই সমান। কোনও র্যাগিং নেই, সিনিয়র জুনিয়র নেই।
হস্টেল জীবনের সঙ্গে পরিচিতি থিয়োরিটিক্যালি হয়েই গেছিল প্রথম একুশ দিনে, এ বার তার প্র্যাকটিক্যাল ইমপ্লিমেন্টেশন। বাড়িতে লম্বা ছুটি কাটিয়ে হস্টেলে ফিরে সকলের খুব মন খারাপ, তাই মনকে সঞ্জীবনী টনিক দেবার জন্য আয়োজন হল উইংসভিত্তিক উৎসবের।
প্রথম হল, আইডি। অনেক কলেজের হস্টেলে একে জিএফও বলা হয়। আইডি হল ইমপ্রুভ্ড ডিনার, আর জি এফ হল গ্র্যান্ড ফিস্ট। একই জিনিস – জলুতে আইডি নামেই চলত। এক এক মাসে এক এক উইংয়ের হাতে থাকত মেসের দায়িত্ব, মাসের একটা দিন তারা কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার বন্দোবস্ত করত, সেদিন এলাহি মেনু। বিয়েবাড়ির খাওয়া। যে ঠাকুরের দল সারামাস দোতলা মাছের ঝোল, নিরামিষ ডিমের ঝোল কিংবা বুকের চুল মেশানো জলীয় ডাল রেঁধে খাওয়াত, তাদের হাত দিয়েই বেরোত পোলাও কালিয়া বিরিয়ানি ইলিশের ভাপা কিংবা চিতলের মুইঠ্যা বা বাটার চিকেন বা পাঁঠার দোপেঁয়াজা। রাত একটা দুটো পর্যন্ত চলত উৎসব।

মন খারাপ কাটানোর দ্বিতীয় পন্থা হল, ভিডিও দর্শন। দুই প্রকার দর্শন হত, মেস ভিডিও, উইংস ভিডিও। মেস ভিডিও মেসের পয়সায়, আবার উইংসের নিজস্ব ফান্ডিংয়ে উইংস ভিডিওও নামত। ভিডিওর কনটেন্ট মোটামুটি চার বছর ধরেই ছিল এক রকমের। সমকালীন দুই থেকে তিনখানি হিন্দি বা ইংরেজি সিনেমা, একটি টুএক্স ব্লু ফিল্ম, দুটি থ্রিএক্স, এর পর কিছু ছেলের সহ্যশক্তি বা বুকের পাটার ওপর নির্ভর করে একটি সেভেন এক্স।
কদমতলার ভিডিওর দোকান থেকেই ভাড়া হত টিভি সেট আর যাবতীয় ভিডিও ক্যাসেট। তখনও ডিভিডি বা ভিসিডির জমানা আসে নি। শো শুরু হত সন্ধ্যে সাতটা থেকে, চলত পরের দিন সকাল সাতটা পর্যন্ত। কনকনে শীত হোক বা বর্ষা, অধিকংশ ছেলেপুলেই সেই রাতে না ঘুমিয়ে সেই সব রেটেড ফিল্ম টিল্ম দেখে পরদিন সকালে বেশ গরম হয়ে ঘুমতে যেত।
সব দেখেছি। তৎকালীন ব্লু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির যাবতীয় ক্যাসেট দেখে শেষ করে ফেলেছিলাম চার বছরে। শেষদিকে কদমতলার দোকানে আর নতুন ক্যাসেট পাওয়া যেত না।
মুভি বাফ তেমন কেউ ছিল টিল না। ফলে উচ্চমার্গীয় সিনেমা হস্টেলে বসে দেখার চলও ছিল না, কলেজেও মুভি ক্লাব জাতীয় কিছু এক্সিস্ট করত না। অবশ্য করলেও ভালো সিনেমার ভালো প্রিন্ট জলপাইগুড়িতে বসে পাওয়াও যেত না, হয় তো আজও যায় না। সব পাঁউরুটি আর ঝোলাগুড়ই কলকাতাকেন্দ্রিক কিনা!
সবই ঠিক আছে, গোলমালটা বাধছিল আসল জায়গায়। অনেক মারপিট করে টিমোশেঙ্কোর ইঞ্জিনীয়ারিং মেকানিক্সের বই তো জোগাড় হল, বোর্ড টি-ও পেয়ে গেছিলাম, কিন্তু মাথায় যে কিছুই ঢোকে না! আজীবন বাংলা মিডিয়ামের ছাত্র, ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে তো বাংলাতে বই হয় না, মেকানিক্সের বই খুললেই কেমন মনে হত পাতার ওপর পিঁপড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্লাসে বেশির ভাগ প্রোফেসরই বাংলায় কথা বলতেন, তাঁদের অবস্থাও যে আমার থেকে খুব ভালো ছিল, এমন নয় – কারণ অন্যান্য ব্যাচের মতই আমাদের ব্যাচেও কয়েকটি অবাঙালি ছেলে ছিল, তারা হাত তুলে নিজেদের বাংলা বুঝতে পারার অপারগতা জানালে তাঁরা বেশ কষ্ট করে ইংরেজিতে শিফট করতেন।
কারুর পড়ানো বুঝতে পারতাম না। প্রায় কারুর না। সেটা আমারই অপারগতা হবে। ‘প্রায়’ লিখলাম এই কারণে, ফার্স্ট ইয়ারে যে কটি ক্লাস বুঝতে পারতাম, সেগুলো ছিল ইঞ্জিনীয়ারিং ড্রয়িং, সোসিওলজি আর সিভিক্স। বাকি সব মাথার ওপর দিয়ে।
টিমোশেঙ্কো ইয়ংএর ইঞ্জিনীয়ারিং মেকানিক্সের বইয়ের দুর্বোধ্য ইংরেজি মোটামুটি ধাতস্থ হতে যতদিন সময় লেগেছে, ততদিনে প্রোফেসরদের মোটামুটি চিনে নিয়ে প্রত্যেকের নকল করার মত কিছু হাস্যকর বৈশিষ্ট্য আমাদের স্বভাবজাত হয়ে গেছে। নিজেদের পাশাপাশি স্যরেদেরও নিকনেম ততদিনে সিনিয়র ইয়ারের থেকে জেনে ফেলেছি আমরা। বইয়ের সাথে মুখ্যত সম্পর্ক থাকত ক্লাসরুমেই, আর মঙ্গলবার রাতে ড্রয়িং বোর্ড নিয়ে বসতাম, কারণ বুধবার ইঞ্জিনীয়ারিং ড্রয়িংয়ের ক্লাস থাকত।
তো, সেইভাবেই আস্তে আস্তে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা এসে গেল। তখন ডিসেম্বর মাস, কন্কনে শীত আর জোলো হাওয়া, কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জও ডুবে গেছে পুরো কুয়াশায়, দিনের কঠিনতম কাজটা ছিল সকালে লেপের তলা থেকে বেরনো, সেই প্রথম শীতের সাথে এল হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা। আমাদের কলেজে হালে সেমিস্টার সিস্টেম হয়েছে, তখন ছিল না। তখন পঁচিশ নম্বরের হাফ ইয়ার্লি হত ইন্টারনাল, পরে পঁচাত্তর নম্বরের অ্যানুয়াল হত, তার পঁচিশ ইন্টারন্যাল, পঞ্চাশ এক্সটার্নাল। এবং সেই এক্সটার্নালের কোশ্চেনও আমাদের কলেজের প্রফেসররাই বানাতেন। কেবল ছাপা হয়ে আসত ইউনিভার্সিটি থেকে।
পরীক্ষা শেষও হয়ে গেল। এমন কিছু কঠিন ব্যাপার লাগল না। দেখা গেল যতটা ভয় করছিলাম, ততটা ভয়ের কিছু ছিল না। এদিকে পরীক্ষা শেষ হওয়ামাত্র হস্টেল আবার খালি। এই সময়ে আমি প্রথম হংসে যাই।
হংস্, অর্থাৎ কিনা, হংকং মার্কেট। কলেজের কাছে নিকটতম শহরাঞ্চল বলতে ছিল, শিলিগুড়ি। অবশ্য, “শহর’ বলতে আমরা যা বুঝি, সেদিনের শিলিগুড়ি তাও ছিল না। াজকের শিলিগুড়িকে দেখে চেনা যায় না – তখন কেবল হিলকার্ট রোড বরাবর দুপাশের বড় বড় দোকান পাট শোরুম ইত্যাদি ছিল, একটু পেছন দিকের বিধান রোড বরাবর বাজার দোকান জনবসতি কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম, কলেজপাড়ার বসতি, স্কুল কলেজ, এই … এই টুকুই ছিল শহর। তারপর ধূ ধূ নির্জনতা, সরু রাস্তা, আধা মফস্সল অ্যামবিয়েন্স। তো, সেই বিধান রোডের এক ধারেই বিধান মার্কেট, চলতি লোকের ভাষায় যার নাম হংকং মার্কেট।
ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছেলেপুলের প্রথম হংকং মার্কেটের সাথে পরিচিতি ঘটে ক্যালকুলেটর কিনতে গিয়ে। সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর, সরাসরি কাঠমান্ডু থেকে স্মাগ্ল্ড হয়ে আসা ক্যাসিও-র মাল, কলকাতার থেকে কিছু না হোক দুশো চারশো টাকা সস্তায় পাওয়া যেত। সেই সময়ে দু চারশো খুব কম টাকা ছিল না – ছোট করে আইডিয়া দিলে বোঝানো যেতে পারে, হস্টেলে মাস চালাবার জন্য বাবা আমাকে মাসে পাঠাত চারশো টাকা। তাতেই মেসের ডিউ, বেড রেন্ট, খাওয়া ঘোরা সব হয়ে যেত, সামান্য কিছু বাঁচতও। ফোর্থ ইয়ারে উঠে আমার মাস চালাবার খরচা বেড়ে হয়েছিল বোধ হয় নশো বা হাজার টাকা।
ফিরে আসি হংকং মার্কেটে। ক্যালকুলেটর কেনা হবে। সে জায়গা থেকে কেনা যেত না, কারণ হংকং মার্কেট পুরোটাই ছিল দু নম্বরীর জায়গা। আজও আছে হয় তো, জানা নেই ঠিক। অধিকাংশ সো-কল্ড চাইনিজ জিনিসপত্র ম্যানুফ্যাকচার হত শিলিগুড়িতেই। তার ওপরে মেড ইন চায়না ছাপ মেরে বিক্রি হত। আসল নকল বোঝার কোনও উপায় ছিল না। এই মার্কেটের মূলত টার্গেট ছিল ‘ফ্লাইং কাস্টমার’, যারা উত্তরবঙ্গে বেড়াতে আসেন, টুরিস্ট, তারা। নকল মাল বাড়ি গিয়ে মাসখানেক ব্যবহার করার পর ধরা পড়ত, তখন আর শিলিগুড়ি ফিরে এসে সেই সব নিয়ে ঝামেলা করর ক্ষমতাও থাকে না কারুর, সে সব জেনেই নিশ্চিন্তে চলত এই বিশাল মার্কেট।
কী কী পাওয়া যেত এখানে? কী পাওয়া যেত না! চাইনিজ ছাপ মেরে যা যা বিক্রি হতে পারে, সব। চার্জার এবং রিচার্জেব্ল ব্যাটারি, রেডিও ঘড়ি ক্যাসেট প্লেয়ার এমার্জেন্সি লাইট ক্যালকুলেটর স্পীকার অ্যামপ্লিফায়ার বাহারি লাইট চাইনিজ তালা স্টেপলার সেলাইকল ব্রা-প্যান্টি জুতো বেল্ট … সমস্ত।
আমাদের ছিল চেনা দোকান। তারা জেনে নিত আমাদের রেগুলার কাস্টমার হিসেবে, কখনও ঠকায় নি। আমরাও ঐ চেনা দু একটা দোকান ছাড়া কোনও জায়গা থেকে কিনতাম না জিনিস। প্রথমবারে আসা হত কোনও সিনিয়রের সঙ্গে, সে-ই পরিচয়টা করে দিত। বাকিটা দোকানদারের স্মৃতিশক্তি। ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছেলেকে নকল জিনিস গছাবার সাহস কারুর ছিল না। কারণ আমরা ফ্লাইয়িং কাস্টমার নই। সেই অটুট বিশ্বাসেই তারাও বেচত, আমরাও কিনতাম। শো কেসে কোনও জিনিস দেখে হয় তো পছন্দ হল, দর করতে গেলাম, জিনিস যদি জেনুইন না হত, দোকানদার আগেই নিচু গলায় জানিয়ে দিত, এইটা ভালো মাল না, দু নম্বরী, আপনি যদি চায়েন তো আনায়ে রাখব, পরের শনিবার আইস্যে নিয়া যায়েন।
অনেক জিনিস কিনে নিয়ে গেছি চার বছরে, হংকং মার্কেট থেকে। সেই ক্যালকুলেটর দিয়ে শুরু। তার বেশ কিছু জিনিস এখনও চলছে, আমাদের বাড়িতে।
কলেজে পরীক্ষা হত, ঐ যেমন বললাম, বছরে দুবার মাত্র। হাফ ইয়ার্লি আর অ্যানুয়াল। মোটামুটি ক্লাস ফলো করলে আর পরীক্ষার আগে একমাস থেকে দেড়মাস ‘ঘষলেই’ পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়া যেত। আর এই পরীক্ষার মরসুমে টের পাওয়া যেত আমার চেনাজানা চৌহদ্দির বাইরেও একটা বিশাল জগৎ আছে, তাতে নানা রকমের সংস্কার, কুসংস্কার, সোজা কথায় বিলিফ সিস্টেম রমরমিয়ে চলে। পরীক্ষা যে হেতু ছাত্রজীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, উত্তরণের একেকটা সিঁড়ির মতন, ফলে এই পরীক্ষার আগে অনেক ছাত্রছাত্রীরই সেইসব ‘মেনে চলা’র ঝাঁপি প্রকাশ্যে খুলে যেত। ছোটখাটো বা বড়সড়। আমাদের ইয়ারের এক ছেলে প্রতি পরীক্ষায় একটা প্রায় ছিঁড়ে আসা জামাপ্যন্টের সেট পরে পরীক্ষা দিত। একবার বাড়ি থেকে আসার সময়ে সে সেই সেট নিয়ে আসতে ভুলে গেছিল বলে তাকে বাড়ির লোক কুরিয়ার করে সেই জামাপ্যান্ট পাঠিয়েছিল। সেটাই নাকি তার লাকি জামা প্যান্ট। সেটা না পরলে নাকি তার পরীক্ষা ভালো হয় না।
তো, এই রকম অনেক সংস্কার আমরা দেখেছি স্কুলজীবনেও, দইয়ের ফোঁটা কালীবাড়ির ফুল থেকে শুরু করে ডাবের জল খাইয়ে দেওয়া বাবা-মা পর্যন্ত, তবে জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের পরীক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল এক অদ্ভূত গণসংস্কার। সেটা ছিল একটা গান। কেউ জানে না এর উৎপত্তি কবে, কোথা থেকে, কিন্তু ইয়ারের পর ইয়ার এই সংস্কারটা অ্যাকুয়্যার করত সিনিয়রদের থেকে, এবং দিয়ে যেত জুনিয়রদের।
গানটা ছিল, জো জিতা ওহি সিকান্দর সিনেমার, পহেলা নশা। এটা পরীক্ষা রিলেটেড গানও নয়, তবু, কেন, কেন যে এই বিশেষ গানটাকেই বাছা হয়েছিল জানি না। চারটে বছরে, প্রতিটা পরীক্ষার আগে, জুতোর ফিতে বাঁধা থেকে শুরু করে কলেজের দিকে এগোন পর্যন্ত শুনেছি হস্টেলে কারুর না কারুর রুম থেকে তারস্বরে ভেসে আসছে সেই গানঃ চাহে তুম কুছ না কহো, ম্যায়নে সুন লিয়া, কে সাথী প্যার কা ম্যায়নে চুন লিয়া, চুন লিয়া।
সংস্কারও ঠিক নয়, পাব্লিক হয় তো নিতান্ত অভ্যেসের বশেই গানটা শুনে ফেলত বা চালিয়ে দিত পরীক্ষায় বেরোবার আগে। কখনও এর অন্যথা হয় নি। জলু হস্টেলের এক রকমের সংস্কৃতিই হয়ে গেছিল এই গানটা। পরীক্ষার সমার্থক। পুজোর আগে যেমন বিশ্বাসী হোক বা অবিশ্বাসী, কান পাতবেই মহালয়ার গানে, এ-ও তেমনি।
এতদিনে হয় তো সে গানের কথা সবাই ভুলে গেছে। কয়েক বছর আগে ভুটান ট্রিপ সেরে জলুতে এক রাতের জন্য থেকেছিলাম, তখন জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম, এই গানের সংস্কারের কথা তাদের একেবারে অজানা। কখন বন্ধ হয়ে গেছে, কেউ জানে না। তাতে আমাদের ঘন্টা, এ শুধু আমাদের সময়ের একটা নস্ট্যালজিয়া, তাদের কী!
প্রথম শীত চলে এল উত্তরবঙ্গে। জানুয়ারি মাস।কাঞ্চনজঙ্ঘা অদৃশ্য হয়ে গেছে কবেই। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ঘন কুয়াশায় ঢেকে যেত চরাচর। তার আগে জীবনে কখনও এত শীত সহ্য করতে হয় নি। তাপমাত্রা প্রায় দুই তিন ডিগ্রি ছুঁয়ে ফেলল প্রথম সপ্তাহেই। হস্টেলের ঘর এমনিতেই খোলামেলা। তার ওপর পাশেই বিস্তীর্ণ চা বাগান, করলা নদী, অদূরেই পাহাড়, আর ঘরে কাচের জানলা। প্রায়শই কাচ ভাঙা থাকত আর পিডব্লুডি সেটা পাল্টানোর নামে মাসের পর মাস টালবাহানা করত, ফলে খবরের কাগজ দিয়ে ঠেকনো দিয়ে রাখা থাকত ভাঙা জানলাগুলো। তরাইয়ের জলবায়ু সবসময়েই ভিজে ভিজে, স্যাঁতসেঁতে, সব মিলিয়ে ঠান্ডা ওখানে বেশ কষ্টদায়ক হয়ে উঠত।
টিনের খাট, তার ওপরে একটা মাত্র তোষক পাতা, তার ওপরে লেপ মুড়ি দিয়ে আমরা, খুব কম ছেলের ভাগ্যেই কাঠের খাট জুটত। দিনের বেলা তাও কেটে যেত, কষ্ট হত রাতে ঘুমোবার সময়ে। সারা শরীর জমে বরফ হয়ে যেত, এপাশ থেকে ওপাশ করতে গেলে ঘুম ভেঙে যেত, মনে হত যেন সারা শরীরে অসহ্য বেদনা, পায়ে সাড় নেই, নাকের ডগায় সাড় নেই, হাতের আঙুলে সাড় নেই। মোজা পরে ঘুমোতে শুরু করলাম, পা বাঁচল খানিক, কিন্তু এপাশ ওপাশ করতে গেলেই ঘুম ভেঙে যেত। সে যে কী অসহ্য কষ্টে কেটেছে প্রতিটা শীত, বলে বোঝানো যাবে না। ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিলাম সকলেই। সকাল এগারোটা কি বারোটা নাগাদ কষ্ট করে সূর্য উঠত, আবার বিকেল তিনটেয় হারিয়ে যেত কুয়াশার আড়ালে।
কুয়াশা। সে বড় ভয়ংকর কুয়াশা। দৈবাৎ সকালে ঘুম থেকে উঠতে হলে ঘর থেকে বেরোলেই মাথা ঘুরে যেত। লম্বা করিডর ধরে পরপর ন দশখানা ঘর, কেবল নিজের ঘর আর পাশের ঘর ছাড়া আর কোনও ঘর দেখা যেত না। করিডরের মাঝামাঝি বাথরুম টয়লেট, কেবল আন্দাজে ভর করে এগনো। চারহাত দূরে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে তাকেও দেখা যায় না, এত ঘন কুয়াশা। রাতের দিকে কুয়াশা হত আরও ভয়ানক। একদিন রাতে এই রকম কুয়াশার ভেতর সাইকেল করে হস্টেলে ফিরছিলাম বাইরে থেকে, কী কারণে কে জানে, রাস্তার আলোগুলোও জ্বলছিল না, জিরো ভিজিবিলিটির প্রভাবে সোজা ধাক্কা মেরেছিলাম একটা মোড়ের রাউন্ড-অ্যাবাউটে। একেবারে সামনে থেকেও দেখতে পাই নি, জাস্ট আন্দাজে রাস্তা বুঝে চলছিলাম। প্রচন্ড চোট আঘাত পেয়েছিলাম।
শিলিগুড়িতে বরং একটু কম ঠান্ডা পড়ত। শিলিগুড়ি একেবারে পাহাড়ের কোলে তো, ফলে ঠান্ডা হাওয়া পাহাড়ে অনেকটাই গার্ড হয়ে যেত। অতটা ঠান্ডা থাকত না। শীতকালে শিলিগুড়ির একটা বড় আকর্ষণ ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের কাছে বসা ভুটিয়া মার্কেট। শীতবস্ত্রের সম্ভার। কী যে সস্তায় সোয়েটার জ্যাকেট পাওয়া যেত সেই মার্কেটে ভুটিয়াদের কাছে, তেমনটি আর কোথাও মিলত না। মার্চ নাগাদ এরা উঠে যেত। আবার বসত পরের বছর ডিসেম্বরে।
শিলাবৃষ্টি ছিল তরাইয়ের শীতকালে উপরি পাওনা। এ শিল আবার আমাদের দক্ষিণবঙ্গের মত মিহি শিল নয়, যে ছাতা মাথায় কুড়োতে বেরিয়ে পড়লাম। রীতিমতো তাগড়া তাগড়া শিল, মাথায় পড়লে আর বেঁচে ফিরতে হবে না। বরফের বড় বড় চাঙড় পুরো। সেকেন্ড ইয়ারেই বোধ হয় দেখেছিলাম শ্রেষ্ঠ শিলাবৃষ্টি। আধঘন্টার মধ্যে হস্টেলের সামনে বিশাল ফাঁকা সবুজ ক্যাম্পাস পুরো সাদা হয়ে গেল। শিলের সাইজ দেখে কেউ বেরোতে সাহস পায় নি। একজন বোধ হয় বেরিয়েছিল, প্রথম শিলের আঘাতেই তার ছাতা ছিঁড়ে ফুটো হয়ে গেল।
তেমন শিলাবৃষ্টি অবশ্য প্রতি বছর হয় না। আমরাও ঐ একবারই দেখেছিলাম চরাচর সাদা করে দেওয়া শিলাবৃষ্টি। তবে শিল পড়লে তা সবসময়েই ঐ বড় বড় চাঙড়ে পড়ে। একবার একজনের পায়ে শিল পড়েছিল, কড়ে আঙুলে, পুরো রক্তারক্তি কান্ড একেবারে!
এদিকে পরীক্ষা শেষ হতেই আবার হস্টেল খালি!
… চলবে
One thought on “জলু – ষষ্ঠ পর্ব”