জলু – সপ্তম পর্ব

ষষ্ঠ পর্বের পর

03
         এই ছবিটা, সম্ভবত ভাইবোন সরণীতে তোলা। ভাইবোন সরণী হল কলেজ আর কলেজ ক্যান্টিন, বা ‘ভাইদার ক্যান্টিন’এর মাঝের রাস্তাটা।

শীতের সময়ে একটা উপরি ছুটি পাওনা হত আমাদের সকলের। ডিসেম্বরের ক্রিসমাসের সপ্তাহ থেকেই পড়াশোনায় ঢিলে পড়ে যেত, শিক্ষক ছাত্র দু তরফেরই পারস্পরিক বোঝাপড়ায় ঐ সময়টাতে কিছুদিন কলেজে পঠনপাঠন বন্ধ রাখা হত। অফিসিয়াল নয়, এমনিই। আমাদের অধিকাংশই যেহেতু ছিল দক্ষিণবঙ্গের ছেলেপুলে, তাই যাওয়া-আসা একইসাথে চলত। পুরো দল হস্টেল খালি করে চলে যেত একসাথে, আবার ফিরতও একসাথে। সমস্ত ব্যাপারটাই ঐ বোঝাপড়ার মাধ্যমে হত, যাতে করে পরে ফিরে কাউকে ক্লাসে পিছিয়ে পড়তে না হয়। মোটামুটি ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এই শীতকালীন ছুটি পাওয়া যেত। এই সময়েই উত্তরবঙ্গের শীতটা অসহনীয় হয়ে উঠত।

অনেকেই, সমস্ত কিছু উপেক্ষা করেও থেকেই যেত হস্টেলে। তেমন শীত তো আর দক্ষিণবঙ্গে জোটে না, সেই শীতকে উপভোগ করারও একটা মজা আছে। সেই মজার বশেই আমরা অনেকেই থেকে যেতাম কলেজ ক্যাম্পাসেই, হস্টেলে। পারলে এন্তার ঘোরো, খাও দাও, কোথাও বেড়াতে যাবার থাকলে বেড়িয়ে এসো এই সময়ে। শীতকালে পাহাড়ে অফ সীজন চলে, সমস্ত হোটেল অর্ধেকেরও কম ভাড়ায় ঘর দিয়ে দেয়। পাহাড়ের বুকে দাঁড়িয়ে হিমশীতল হাওয়া বুক পেতে নেওয়ার সাহস তো কুড়ি একুশ বছরেই সবচেয়ে বেশি থাকে।

সে বার, আমরা বোধ হয় সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, শীতের সময়ে, বছরের শেষ সপ্তাহে হস্টেল যথারীতি খালি হয়ে গেল। মেস বন্ধ, ক্যাম্পাস খালি, ভূতের মত পড়ে রইলাম আমরা জনা পনেরো-কুড়ি জন ছেলে। বছরে দুবার বাড়ি যাওয়া তো এমনিই হত, গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটি, বছরে তিনবার যাওয়ার মত এনার্জি তেমন হত না আমার।

আমাদের কলেজে একটা ট্রেকার্স ক্লাব ছিল। অনেকেই ওখান থেকে ট্রেকিং কিট নিয়ে সান্দাকফু ট্রেকিং করতে যেত। খুব নাকি এনজয়েবল জার্নি ওটা। খরচা হয় কয়েক হাজার। কিন্তু খরচাটা গায়ে লাগে না যখন কেউ সফলভাবে গৈরীবাস-টাস হয়ে সান্দাকফু ট্রেক করে ফেরে। যে সময়ের কথা বলছি, তখনও সান্দাকফু ট্রেকিং একটা ‘ব্যাপার’ ছিল, আজকের মত অগুন্তি বাটুদের হাতে সান্দাকফু পপুলার ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে দাঁড়ায় নি।

তো, সেই সময়ে খরচাটা করার মত সঙ্গতিও আমার ছিল না। সান্দাকফু ট্রেক করতে যাবার জন্য বাবার কাছে কয়েক হাজার টাকা চাইলে বাবা ঠিক কীরকম রিয়্যাক্ট করতে পারত, আমার আইডিয়া ছিল না। সাহস করি নি চাইবার। হস্টেলের পনেরো-কুড়িজন ছেলের মধ্যে জনা আষ্টেক ছেলেপুলে, ট্রেকার্স ক্লাব থেকে তল্পিতল্পা ভাড়া নিয়ে চলল সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে। পড়ে রইলাম আমরা আরও কম কিছুজন।

মেস বন্ধ। খাওয়া দাওয়ার টেম্পোরারি অ্যারেঞ্জমেন্ট নবীনদার ক্যান্টিনে। দু নম্বর হস্টেলের ক্যান্টিন। মেসের খাওয়া যতটা জঘন্য ছিল, তত ভালো ছিল নবীনদার হাতের রান্না, ফলে হস্টেলের মেস বন্ধ হয়ে গেলে আমরা কদিন নবীনদার ক্যান্টিনে খেয়ে সুখ পেতাম। নবীনদা ছাত্রমহলে অত্যন্ত পপুলার ছিল মূলত তার রান্নার হাতের জন্য। বলতাম, বলিউডের হিরো গোবিন্দা, আর আমাদের জলিউডের হিরো নবীনদা।

তো, সেই আরও কম কিছুজন মিলে যখন ক্যান্টিনে বসে গুলতনি মারছি, আমরাও অল্প খরচে কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসতে পারি কিনা, তখন নবীনদাই উপযাচক হয়ে পরামর্শ দিল, বোদাগঞ্জ চলেন।

জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের যেদিকে জলপাইগুড়ি শহর, তার ঠিক উল্টোদিকে প্রায় ষোল-সতেরো কিলোমিটার দূরে ছিল বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকা এই বোদাগঞ্জ ফরেস্ট। যোগাযোগ বলতে কিছু নেই, কেবল দিনে একটি উত্তরবঙ্গ পরিবহনের ভাঙাচোরা লাল-নীল রঙের বাস যেত ওদিকে, আর দিনের শেষে ফেরৎ আসত ধুঁকতে ধুঁকতে। আমাদের কলেজটা যে পাড়ায়, তার নাম ডেঙ্গুয়াঝাড়। কলেজ লাগোয়া চা বাগানের নামও ছিল ডেঙ্গুয়াঝাড় টি এস্টেট। এই ডেঙ্গুয়াঝাড় থেকে খানিক দূরে রংধামালি নামের একটা ছোট্ট গ্রাম পেরিয়ে যেতে হয়। আরও বেশ অনেকটা দূরে, বনেরও একেবারে শেষ মাথায় বিশাল বড় তিস্তার ড্যাম, সেই ড্যামের কোলেই এই জঙ্গল।

ঠিক হল, এই বোদাগঞ্জেই যাওয়া হবে পিকনিক করতে। সাতজন রাজি হয়ে গেল। অল্‌ সেট।

বাস আমাদের কলেজের রাস্তা দিয়েও যায় না, আর আমরা বাসের পরোয়াও করি না। সাতজন সাতটা সাইকেল, পথপ্রদর্শক নবীনদা। জনপ্রতি একশো টাকা, আর কিছু বস্তা, চাল-ডাল বেঁধে নিয়ে যাবার জন্য।

কথা ছিল সকাল সকাল বেরোব, কিন্তু শীতের দিন, ঘুম থেকে উঠে রেডি হতে হতেই বেলা এগারোটা বেজে গেল। তখন প্ল্যান চেঞ্জ করে ঠিক করা হল, আমরা জঙ্গলে রাত্রিবাস করব, বেশ অ্যাডভেঞ্চার হবে। কে যেন খবর এনেছিল, ওখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাংলো আছে, দরকার পড়লে সেখানেই থাকা যাবে। চালাও পানসি বেলঘরিয়া। দুপুর দেড়টা নাগাদ অবশেষে খেয়ে দেয়ে বেরোলাম বোদাগঞ্জের উদ্দেশ্যে। খাবারের সরঞ্জাম, নবীনদাই বলল, এখান থেকে নিয়ে যাবার মানে হয় না, রংধামালিতে কিনে নিয়েন। তাই হল। পথে রংধামালিতে কিনে নেওয়া হল চাল ডাল মুরগি ইত্যাদি। বাংলা এবং ইংরেজি তরলেরও জোগাড়যন্ত্র হয়ে গেল। শুরু হল যাত্রা।

রংধামালি কলেজ থেকে দশ কিলোমিটার মত দূরে। একটা নিতান্তই ছোট গঞ্জ। কয়েকঘর মাত্র লোকের বাস। হাটের দিন ছাড়া ভিড় হয় না। সেইখানে পৌঁছে একটু জিরিয়ে নেওয়া গেল, তারপরে আবার এগোলাম। বিকেল চারটে নাগাদ পৌঁছলাম বোদাগঞ্জ ফরেস্ট।

নামেই ফরেস্ট, বন্যজন্তু-টন্তু কিছুই নেই সেখানে, লম্বা লম্বা শাল সেগুন গাছের সারি, কাঠকুড়ুনি মেয়েবউরা সেখানে শুকনো পাতা-টাতা আর কাঠকুটো কুড়োয়, ফরেস্টেরই একপ্রান্তে একটা ছোট বসতি মতও আছে। পায়ে চলা আর সাইকেলে চলা একটা রাস্তা তৈরি হয়ে আছে আপনাআপনি, সেই পথ ধরে একটু এগোতেই চোখে পড়ল বনবিভাগের অফিস, চৌকিদারের কোয়ার্টার, আর … আর হ্যাঁ, আমাদের রাত্রিবাসের উপযুক্ত একটা ফরেস্ট বাংলো। ঠিক গল্পে যেমন বিবরণ পড়েছি এতদিন, সেই রকম, বড় বড় কাঠের লগ দিয়ে মাটি থেকে উঁচু করে বানানো একটা আদ্যোপান্ত কাঠের বাড়ি, মাথায় ঢালু কাঠের ছাদ। বাইরের দিকে তিন ধার জুড়ে কাঠের করিডর বানানো, কাঠের রেলিং, আর তার ঠিক পেছন দিয়েই একটু দূরে, মাঝারি সাইজের নানা রকম বোল্ডারের ওপর দিয়ে কুলকুল করে নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে তিস্তা নদী। চারদিকে এতটুকু শব্দ নেই, আমাদের হইহল্লা ছাড়া। আর আমরা চুপ করলেই, কেবল শোনা যাচ্ছে শুকনো পাতার সরসর আওয়াজ। রাশি রাশি শুকনো শালপাতা আর সেগুনপাতা।

চৌকিদার কোথায়? (তখন চৌকিদার বলতে আমরা চৌকিদারই বুঝতাম, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নয়) খুঁজেপেতে চৌকিদারকে বের করা হল। লাটসাহেবি চালে আমাদের মধ্যে কেউ একজন তাকে বলে বসল, অ্যায়, ঘর খুলে দাও, আমরা থাকব এখানে আজ রাতে, জলপাইগুড়ি ইঞ্জিন কলেজ থেকে আসছি।

তা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের চৌকিদার কি অত সহজে ভোলে? পরিষ্কার বলে দিল, রেঞ্জার সাহেবের কাছ থেকে পারমিশন না পেলে সে কাউকেই ঘর খুলে দেবে না। … কেলো করেছে! রেঞ্জার কোথায় থাকে? তিনি এই ফরেস্টেই থাকেন, ঐ পাশের কাঠের বাড়িটা ওনার, কিন্তু উনি এখন গঞ্জে গেছেন, একটু বসতে হবে।

এই বার একটু ভয় করতে শুরু করল, ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসার, না জানি কি জাঁদরেল লোক হবেন টবেন। ধমকেই যদি ভির্মি খেয়ে যাই, তা হলে বার্গেইন করব কী করে? আমরাই উদ্যোগী হয়ে গঞ্জ খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম, পেয়েও গেলাম একটু হাঁটতেই, ছোট্ট গ্রামের মধ্যেই আরও ছোট্ট একটা চত্বরে গুটিকয় দোকান, তার নাম গঞ্জ। বোদাগঞ্জে তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি, তাই বেলাবেলি এখানে লোকে দোকানবাজার সেরে ফেলে সন্ধের মধ্যে বাড়ি ঢুকে পড়ে, বন্য জন্তু না থাকলেও অন্ধকারে জঙ্গলে পথ হারয়ে ফেলা বিচিত্র নয়। তো, সে যাই হোক, সেখানে গিয়ে জিগ্যেস করতেই রেঞ্জার সাহেবকে দেখিয়ে দিল। তাঁকে দেখে এবার আমরা সত্যিই ভির্মি খেলাম। আমি নিজে চরম রোগা প্যাংলা ছেলে, আমার সামনে যাঁকে দেখতে পাচ্ছি, সেই রেঞ্জার সাহেব আমার থেকেও বেশি রোগা, স্রেফ ফুঁ দিলে উড়ে যাবেন এ রকম চেহারা, ওই শরীরে সাদা শার্টটাও যেন লাগছে কাকতাড়ুয়ার মতো, একটা বাঁশের তৈরি বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছেন। বুকে বল এল। গিয়ে মিহি গলায় দাবি পেশ করলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলে, বেড়াতে এসেছি, দয়া করে আজ রাতের মতো বাংলোটা যদি দ্যান … উনি ততোধিক মিহি গলায় বললেন, বাংলো তো ও ভাবে দেওয়ার নিয়ম নেই, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বড় বড় অফিসাররা যখন আসেন, তখন তাঁদের জন্য এই বাংলো রাখা থাকে। এমনিতে এখানে থাকতে হলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লিখিত অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। আর সেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিস হল গিয়ে শিলিগুড়িতে। সুতরাং …

কিছু করার নেই, ধরে বসে পড়লাম, উনিও দেবেন না, আমরাও ছাড়ব না। প্রচুর তেল মারা, মাখন মারার পর (জলুর ভাষায়, মাল নামানোর পরে), মাল অবশেষে নামল। উনি চাবি দিলেন, সঙ্গে বললেন, “দ্যাখো, ঘর আমি দিচ্ছি, কিন্তু এটা বেআইনি কাজ, যদি আজ রাতের মধ্যেই কোনও ফরেস্ট অফিসার বাই চান্স চলে আসেন এখানে, তোমাদের কিন্তু দেন অ্যান্ড দেয়ার বাংলো ছেড়ে দিতে হবে।”

তখন পূর্বাপর ভাবার মত বয়েস হয় নি। ঐ জঙ্গলে ঐ চরম ঠাণ্ডায় রাতে ঘর থেকে বের করে দিলে কী হতে পারে, সে সম্বন্ধে জাস্ট কোনও আইডিয়াই ছিল না। অতএব, তাই সই। হই হই করে ঢুকে পড়লাম বাংলোতে। বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস লাগছল তখন। জীবনে কোনওদিন কাঠের বাড়িতে থাকি নি। শুনেছি, বাবা যখন আলিপুর দুয়ারে পোস্টেড ছিল, আমার যেখানে জন্ম, সেইখানে তারা কাঠের বাড়িতে ভাড়া থাকত, কোয়ার্টার পায় নি বলে।

আমি প্রথম দেখছি কাঠের লগ হাউস। কাঠের ঘর। কাঠের মেঝে, পা ফেললেই মচ মচ করে একটা অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছিল। দুটো বেডরুম, একটা ডাইনিং হল, একটা কিচেন, লাইট ফ্যান সমস্ত কিছুরই সুইচ আছে, কিন্তু টিপতে কিছুই জ্বলল না। গেলাম আবার রেঞ্জার সাহেবের কাছে। তিনি তখন নিজের ঘরে বসে ভাত রাঁধছিলেন, আর টিভিতে ডিডি ওয়ান চলছিল। বারান্দায় রাখা একটা বিশাল বড় সোলার সেল। ওতেই ওনার তিনটে আলো জ্বলে, আর টিভিটা চলে। কাছেই রিলে সেন্টার থাকায় ডিডি ওয়ানটা দেখতে কোনও অসুবিধে হয় না। … যখনকার কথা বলছি, তখনও শহর কলকাতায় অ্যান্টেনার ছড়াছড়ি, কেবল টিভি তখনও আমাদের জীবনে প্রবেশ করেনি সেই অর্থে। রেঞ্জার সাফ জানিয়ে দিলেন, ওই বাংলোর আলো জ্বলে জেনারেটরে, বড় অফিসার এলেই জেনারেটর চালানো হয়, এখন সম্ভব নয়। উনি জানালেন, এখনো গঞ্জে গেলে মোমবাতি পাওয়া যাবে, আমরা নিয়ে আসি যেন। সন্ধ্যে সাতটা, অন্ধকার থয়ে গেছে চাদ্দিক, দোকান এক্ষুনি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, দৌড়ও।

তথাস্তু। কয়েকজন দৌড়ল গঞ্জে মোমবাতি আর কেরোসিন কনতে, আমি থেকে গেলাম রেঞ্জার সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে। বেচারা নিঃসঙ্গ মানুষ, কিছু মদেশিয়া ওরাওঁ আদিবাসী ছাড়া কথা বলার কেউ নেই। তাঁর বাড়ি কোথায়? … শুনে চমকে গেলাম, তাঁর বাড়ি শান্তিনিকেতন। নাঃ, রবি ঠাকুরের লেখা উনি পড়েছেন ইশকুলে সবাই যেমন যতটুকু পড়ে টড়ে আর কি, নিজে কোনও দিন পদ্য লেখার চেষ্টাও করেননি, সাধারণভাবে লেখাপড়া শেষ করে বনবভাগের এই চাকরিটা পেয়েছেন, তাতেই দেশে তাঁর বাড়ির লোকের গ্রাসাচ্ছদন হয়ে যায়। কোনও মিল নেই, তবু আমার হঠাৎ করে কেন জানি ঘুণপোকা উপন্যাসের সুবোধ মিত্তির চরিত্রটা মনে এল। … আর তাঁর নিজের শখ আহ্লাদ? শখ মেটাবার উপায় কোথায় এই পান্ডববর্জিত জঙ্গলে? মাসে একবার জলপাইগুড়ি টাউনে যান, মাসের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করে চলে আসেন, কখনও রূপশ্রী, রূপমায়া কি অন্য কোনও হলে একটা দুটো সিনেমা। উনি কথা দিলেন, এর পরে জলপাইগুড়ি টাউনে গেলে অবশ্যই আমাদের হস্টেলে বেড়াতে আসবেন।

ততক্ষণে বন্ধুরা চলে এসেছে। এসে শোনাল তাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজে, চতুর্দিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, সমস্ত দোকান বন্ধ, সব্বাই নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে। কোনওমতে একটা দোকান খুলিয়ে কিছু বিড়ির প্যাকেট, এক বোতল কেরোসিন আর মোমবাতি দেশলাই কিনে আনা গেছে। রেঞ্জার শুনে হাসলেন। বললেন, এখানে সন্ধের পরে জীবন এই রকমই। কোথাও আলো নেই তো, তাই এরা সন্ধে হলেই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে, আবার ভোর থেকে উঠে দিনের কাজ শুরু করে। এখানকার বাচ্চারা পড়ে না,সন্ধেয় এমনকী কোনও অনুষ্ঠানও হয় না। সন্ধে হলেই গ্রামটা পুরো জঙ্গলের অন্ধকারে ডুবে যায়।

মহানন্দে আবার প্রবেশ করা গেল বাংলোতে। একটা জিনিস দেখলাম, মশা নেই, সেটা ঠান্ডার জন্য কিনা, কে জানে!! নবীনদা রান্না করল, গরম গরম মাংসের ঝোল আর ভাত। সঙ্গে চাটনি। ও হ্যাঁ, সমস্ত পিকনিকের যেটা অবশ্যম্ভাবী অঙ্গ, আমাদেরও তাই হয়েছিল, মাংস রাঁধার আগে জানা গেল, নুন আনা হয়নি। তখন বাজে রাত ৯টা। কোনও আশা নেই দোকানে গিয়ে নুন কিনে আনার। আবার হানা দেওয়া হল রেঞ্জারের বাড়ি। উনি বোধ হয় অল্প বিরক্ত হলেন। তবে, নুন পাওয়া গেল।

খাওয়া শেষ হতে হতে রাত এগারোটা বেজে গেল। দুই ঘরে রাজকীয় বিছানা, কিন্তু বেড়াতে এসে কি ঘুম আসে? আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম তিস্তার পাড়ে। অনেক, অনেক রাত্তির অবধি গান হল। নদীর চরটা ফাঁকা থাকায় চাঁদের আলো এসে পড়েছিল নদীর জলে। বড় মায়াবী লাগছিল পরিবেশটা। নবীনদার কাছে শুনলাম, অনেক সময়ে গণেশজিরা নাক এখানে আসে জল খেতে (রাত্তিরে হাতিদের নাম নিতে নেই কিনা; য়ামরা শুনে হেসেছিলাম, কিন্তু ফি বছর যাদের ঘর দোর ফসল খেত তছনছ হয় হাতিদের তাণ্ডবে, তারা হাতিকে যুগপৎ ভয় ও ভক্তি করেই চলে)। অনেক রাতে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলম, এক দল তো তরলের প্রভাবে আগেই ঘুমিয়ে নাক ডাকাচ্ছিল কাঠের ঘর কাঁপিয়ে, আমরাও অন্য ঘরে জায়গা নিলাম।

পরদিন সকালে আমাদের কেউই রেঞ্জার সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসার সৌজন্যটুকু পর্যন্ত বোধ করিনি। চৌকদারের মেয়েকে চাবি ফিরিয়ে দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসেছিলাম সাইকেলে। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে আবার সেই চিরাচরিত জীবনে ফেরত।

সেই রেঞ্জার আর আসেননি আমাদের হস্টেলে বেড়াতে। আমারও আর বোদাগঞ্জ যাওয়া হয়নি। দেখা হয়নি আর তাঁর সঙ্গে।


01
                                                    আমাদের উইং। দু নম্বর হস্টেলের দোতলা ব্যাক। কলেজ বিল্ডিংয়ের সামনে।

 

আমার কলেজের গল্পে মেয়েরা নেই। চতুর্থ পর্বে লিখেছিলাম ‘মেয়েদের’ সঙ্গে আলাপ হবার গল্প লিখব – তারপরে আর লেখা হয় নি। এখন লিখি, সে গল্প?

তখন ফার্স্ট ইয়ার। কলেজের একটা পোস্ট অফিস ছিল, পিনকোড ৭৩৫১০২। কলেজের দু নম্বর গেটের দিকে একটা ভাঙাচোরা বিবর্ণ বাড়ি, তার পেছন দিকে একটা জানলা। পোস্টম্যান ছিল না বোধ হয় কেউই, লাঞ্চ ব্রেকের সময়ে আমরা কেউ গিয়ে দু নম্বর হস্টেল, এক নম্বর হস্টেল ইত্যাদি যে যেখানকার বাসিন্দা, সেখানকার হস্টেলের চিঠির গোছা নিয়ে হস্টেলে আসত।

তখন পোস্টকার্ড ছিল পনেরো পয়সা, ইনল্যান্ড লেটার ছিল পঞ্চাশ বা পঁচাত্তর পয়সা, আর মুখবন্ধ খামের জন্য লাগত এক টাকা। এমনি একদিন, বেশ একটা রঙীন খামে আমার নামে একটি বেয়ারিং চিঠি এল। এমনিতে বেয়ারিং চিঠি ডেলিভারির সময়ে ডবল চার্জ দিতে হত, এক টাকার খামে লাগত দু টাকা, কিন্তু জলুর পোস্ট অফিসে রোজ অমন পঞ্চাশ একশো দেড়শো চিঠি আসত, কেউ আলাদা করে খেয়াল করত না কোনটা বেয়ারিং, সবই চলে আসত। তো, এই চিঠিটাও আমার কাছে এল। আমি সেদিন পোস্ট অফিসে যাই নি, হস্টেলে এসে লেটার বক্সের সামনে দেখলাম।

অচেনা হাতের লেখা। আমার হুগলির বান্ধবীদের কেউ নয়, ঘরে গিয়ে খুলে দেখি, ইংরিজি বাংলা মিশিয়ে কেউ খুব খিল্লি করেছে আমাকে নিয়ে, ঠিক কী লেখা ছিল, আমার মনে নেই আজ, তবে মোদ্দা কথা ছিল ‘হিঃ হিঃ হিঃ, কীরে ব্যাটা, ভেবেছিলি ধরা পড়বি না, এইবারে দ্যাখ – কেমন আমরাও পাল্টা দিতে জানি। নে, এবার দু টাকা দিয়ে আমাদের খিল্লি পড়।

তখন দু টাকা মানে অনেকখানি, কিন্তু আমাকে বেয়ারিংয়ের চার্জ দিতে হয় নি, এমিনিই পেয়ে গেছি চিঠিটা, ফলে যে বা যারা এই কাজটা করেছে, তারা জানতেও পারে নি, তাদের ‘পাল্টা’ দেবার চেষ্টা মাঠেই মারা গেছে।

এখন, কীসের পাল্টা? কে দিচ্ছে পাল্টা? আমাকে কেন? যথাসম্ভব নির্লিপ্তভাবে খোঁজখবর চালাতে শুরু করলাম, দু তিনদিনের মাথায় জানা গেল, চিঠিটি অরিজিনেট করেছে লেডিজ হস্টেল থেকে। 

এবার আমার চমকাবার পালা। আমাদের ইলেকট্রিকালে তিনটে মেয়ে, তাদের কেউ আমাকে নিয়ে এই ধরণের খিল্লি করবে, মানে, সে ধরণের পরিস্থিতিই তৈরি হয় নি কখনো, আমি রীতিমত গুডি গুডি বয়। এবার গিয়ে যে জিজ্ঞেস করব, সে সাহসটুকুও ছিল না, কী জানি, তখন ভেবেছিলাম, জিজ্ঞেস করলে যদি বুঝতে পেরে যায়, চিঠিটা আমার হাতে এসেছে! বুঝতে পারলেই বা কী হত, জানি না, মোদ্দা কথা, জিজ্ঞেস করি নি তাদের, কিন্তু যে কোনওভাবেই হোক, জানা গেল আইডিয়াটা আমাদের ব্যাচের মেয়েদেরই, চিঠিটা লিখেছে ডিপিসি। 

আসল নাম নিয়ে টানাটানি না করাই ভালো এতদিনে, আমার ব্যাচের যারা পাঠক, তারা সবাই চিনবে ডিপিসিকে। তো, নাম জানার পরে রোখ চাপল, উত্তর দিতে হবে। ডিপিসি ইলেকট্রিকালেরই মেয়ে ছিল, একই ক্লাসরুম, কথা বলে নিলেই ল্যাঠা চুকে যেত, কিন্তু ঐ যে বললাম, কলেজের কালচারটা খুব একটা সুস্থ ছিল না সেই সময়ে। কলেজের মধ্যে বা ক্যাম্পাসের মধ্যে একটা মেয়ের সাথে কথা বলছি, এটা দেখতে পেলে অনেক রকমের রঙ্গরসিকতা চলত ধারাবাহিকভাবে, এবং তার বেশির ভাগই খুব একটা শ্লীলতা বজায় রাখত না। আমাদের দু ব্যাচ পর থেকে পরিস্থিতি উন্নত হতে শুরু করে, কিন্তু আমাদের ব্যাচে অন্তত, ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে ছিল এক দুর্ভেদ্য পাঁচিল। আমরা সবাইই দায়ী ছিলাম তার জন্য।

সেই অসুস্থ সংস্কৃতির চাপেই কেউ একটি চিঠি লেখে লেডিজ হস্টেলের ঠিকানায়, সম্ভবত ডিপিসি, অথবা অন্য কোনও মেয়ের নামে। তাতে খুব একটা ভদ্র কথা ছিল না, সেটা আন্দাজ করাই যায়, কেন কী বৃত্তান্ত, কিচ্ছু জানি না – তারা ভেবে বসে, সেটা নাকি আমার লেখা। … এখন, চিঠি আমি লিখি ঠিকই, মানে লিখতাম সেই সময়ে, কিন্তু ঐ ধরণের বেনামী নোংরা চিঠি আমি কেন লিখতে যাবো, আর কেনই বা তারা আমাকে সন্দেহ করেছিল, আমার জাস্ট কোনও আইডিয়া সেদিনও ছিল না, আজও নেই। সম্ভবত আমাদের ব্যাচেরই কোনও ছেলের কীর্তি এটা, সম্ভবত আমি জানি-ও তার নাম, কিন্তু, এত বছর বাদে, থাক সে-সব কথা।

তো, ডিপিসিকে উত্তর দিতে হবে। ততদিনে ফোর্থ ইয়ারের এক কবি কবি টাইপের আঁতেল দাদার সঙ্গে বেশ ভাব জমে উঠেছিল। সে শিল্পী মানুষ, ছিল, করলা নদী আর চা বাগানের মোহে মজে গিয়ে সেখানে বসে কবিতা লিখতে লিখতে কখন যে একটা বছর নষ্ট হয়ে গেছে, খেয়াল করে নি। নাম ছিল সামথিং মণ্ডল, লিখত সামথিং শেখর। আসল নামে যাব না এতদিন পরে। সেই কবি-কবি দাদাকে গিয়ে ধরলাম। ‘লেডিজ হস্টেলে’র নামে চিঠি লেখা হবে শুনে সে-ও বেশ তড়বড়িয়ে উঠে বসল, এবং এক রাত মকশো করার পরে একটি সুঠাম চিঠি তৈরি হল। বেশ কাব্যিক ভাষা দিয়ে, গদ্যতেই – এতদিনে অবশ্যই তার কনটেন্ট আর কিচ্ছু মনে নেই, শুধু মনে আছে উল্টো খিল্লি করেছিলাম, যে – ভেবেছিলি আমাকে দিয়ে বেয়ারিংয়ের ডবল চার্জ দেওয়াবি, আমাকে এক পয়সাও দিতে হয় নি, আর তোরা যে ভেবেছিলি আগের চিঠি আমার পাঠানো, সেই ধারণা তোদের কেন হয়েছিল জানি না, তবে ঐ ধরণের চিঠি পাঠানোর মত ছেলে আমি নই। দরকার হলে হাতের লেখাও মিলিয়ে দেখতে পারিস।  আর, আমি তোদের মতন ইয়ে নই, এটা বেয়ারিং পাঠালাম না, দ্যাখ, ওপরে এক টাকার ডাকটিকিট মেরে দিয়েছি।

এর চারদিন পরের কথা। এস আর সি-র ক্লাস সেরে করিডরে বেরিয়েছি, পেছন থেকে মিহি সুরে ডাকঃ ‘অ্যাই শওমীইক’। ডিপিসি।

ডিপিসির বাড়ি ছিল গড়িয়াহাট বা ঢাকুরিয়া বা অন্য কোথাও। সাউথ কলকাতার টিপিকাল ট্যাঁশ মেয়েদের মত উচ্চারণ ছিল তার (এই যে সব মেয়েরা চুমু দিয়ে চপ খায়, বা বয়ফ্রেন্ডকে ফেস্টের সন্ধ্যেয় বলে, দেয়ার ইজ সো মাচ কাদা, ইউ নো, আই কান্ট সিট হাঁটু মুড়ে, সেই ধরণের উচ্চারণ)। সেই উচ্চারণে ডাকল, ‘অ্যাই শওমীইক।’

আমি পেছন ফিরলাম। খুব খুব অ্যাপোলোজেটিক ভঙ্গীতে ডিপিসি বলল, সরি রে। আমরা ভেবেছিলাম, ওটা তুই লিখেছিলি।

ভুল ভাঙতে এক মিনিট, আর বন্ধুত্ব হতে আরও এক মিনিট। এই সামান্য সময়টুকু ব্যয় করতে পারে নি আমাদের ব্যাচের, আমাদের আগের ব্যাচের, আগের আগের ব্যাচের … বহু ছেলেই।

… চলবে


5 thoughts on “জলু – সপ্তম পর্ব

  1. তোরা বোদাগঞ্জ এ গেছিলি!!?? ভূত দেখিস নি আমাদের মত?? সে আর এক কাহিনী বটে, আমি, বিরাজ, আবির, পলাশ, কেষ্টা, হোৎকা, সৌগত ও ভঙ্কু তে মিলে সে এক দারুন রাত। বিরাজ লিখেছিল।
    রেঞ্জারের নামটা বোধয় আমাদের ক্যাম্পাসের ভেতরের std বুথের মালিকের নামে নাম ছিল। নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না।
    আমি পোস্টাপিস থেকে একবার পি ডি কলেজের এক ছাত্রীর নামের একটা চিঠি পেয়েছিলাম , ভাবা যায়!
    মন্ডল দা কে মনে পড়ে গেলো। অনেক আড্ডা দিয়েছি একসময়।

    Like

  2. প্রিয় শমীক,

    জঙ্গল, পাহাড়, সমুদ্র, নারী
    এই সব প্রিয় মুহুর্তদের মায়াজালে
    শুধুই সর্বস্বান্ত হওয়া যায় ঘুরে ঘুরে,
    তোর লেখায় তাই স্মৃতির বালুচরে
    নতজানু হয় এই ঘাসের হৃদয়।

    ▪︎ এতদিন পরে কখনও কখনও মনে হয় কাঞ্চনজঙ্ঘা, রুকরুকা, ডেঙ্গুয়াঝাড়, রংধামালির মতো পাহাড়, নদী আর জঙ্গলের মোহে মজে ওই অতিরিক্ত সময় বোধহয় আমার উপরি পাওনা ছিল। তাই আজও রয়ে গেছি সেই দূর পাহাড়ের মেঘের দেশে। পারলে আসিস। নিমন্ত্রণ রইল।
    ▪︎ প্রাপকের কাছে তোর সেই কন্টেন্ট ভুলে যাওয়া চিঠিটা কি এখনও আছে ? তোর কি মনে হয়?

    এ এক অমলিন স্মরণ।
    বৃষ্টি নামে নিঃশব্দে
    ভেজা বাতাসে
    ঘুম থেকেই স্বপ্নে জাগরণ।

    Liked by 1 person

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.