সবই চলছিল নিজের মতন করে। কলেজ জীবন, বাড়ি থেকে প্রায় ছশো কিলোমিটার দূরে, যা যা স্বাধীনতা উপভোগ করা সম্ভব, হয়ে চলেছিল নিজের মত করেই। কিন্তু আসল জায়গাটিতে খুব সুবিধে করে উঠতে পারছিলাম না। টিমোশেঙ্কোর বিভীষিকা শেষ হতে না হতেই হাতে চলে এল লাল রঙের ডিকশনারির মতন মোটা বই – পরের দু বছরে এটাই বুঝে উঠতে পারলাম না লেখকের সারনেমটা কী ছিল, থেরেজা, নাকি থেরাজা, নাকি দি-রাজা। ভেতরের কনটেন্ট, ক্লাসে প্রোফেসরদের লেকচার, সমস্ত, প্রায় সমস্ত কিছুই মাথার ওপর দিয়ে যেত। কীভাবে পরীক্ষাগুলোতে টেনেমুনে পাস করে যেতাম, এতদিন বাদে তা আর আমার মনে নেই – এটা মনে আছে, সেকেন্ড ইয়ারে ইলেকট্রনিক্সে সাপ্লি পেয়েছিলাম। বেসিকালি যদ্দূর মনে পড়ছে, সাপ্লির পরীক্ষাতেও সাপ্লি পেয়েছিলাম, দু বারের চেষ্টায় পাসমার্ক তুলতে পেরেছিলাম, ততদিনে আমি থার্ড ইয়ারে উঠে গেছি।
থার্ড ইয়ারে উঠে বুঝে গেছিলাম, ইঞ্জিনীয়ারিং আমার জন্য নয়। এখন, এত দেরিতে এই বোধোদয় হয়ে বিশেষ কিছু লাভ হবার ছিল না, যেভাবেই হোক, শর্টকাট বেছে নিয়েছি, তাতেও সুবিধে করে উঠতে পারছি না – এদিকে জীবনে কিছু একটা করে উঠতেই হবে, কিন্তু কী করব, কী করতে পারি, সে সম্বন্ধে জাস্ট কোনও আইডিয়া ছিল না। বাস্তবে প্রচণ্ড আতঙ্ক হত, ভয় লাগত, চার বছর না হয় কোনওভাবে কেটে যাবে, তারপরে কী হবে? সেই আতঙ্ক থেকে দূরে থাকার জন্য আবার জুটে যেতাম হস্টেলের মাসিক ভিডিও শো-তে, কিংবা দল বেঁধে টাউনে ঘোরাঘুরি করতে বেরিয়ে যেতাম, মাঝেমধ্যে মেসের খাওয়া নিতান্ত অসহনীয় হয়ে উঠলে একটু দূরে ময়নাগুড়ি বাইপাসের ধারে বাচ্চুদার ধাবা তো ছিলই, পাঁচ বা সাত টাকায় ভরপেট রুটি আর ডিম-তরকা খেয়ে আসা যেত।
মোটামুটি একটা আন্দাজ করে নিয়েছিলাম, ইঞ্জিনীয়ারিং জ্ঞান দিয়ে জীবন কাটাতে পারব না, সুতরাং, যেভাবে হোক, ফার্স্ট ডিভিশন মার্কসটুকু মেনটেন করে যেতে হবে। তার জন্য যতটা ঘষাঘষি করা প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই করতাম। বাকি সময় কাটত, কালচারাল, সোশাল বা ম্যাগাজিন কমিটির কাজকর্মে।
থার্ড ইয়ারের শীতের ছুটিতে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, ভুটান যাব। জলপাইগুড়িতে আছি, এত কাছে থাকি, ছোট্ট করে একটা ফরেন ট্যুরের সুযোগ এমনি এমনি ছেড়ে দেব? আমাদের পার্সেও তো অনবরত ঢুকত আর বেরোত ভুটানের টাকা। জলপাইগুড়ি শহরে ভুটানের নোট ভারতীয় নোটের মতই একই হারে চলত।
আমাদের হস্টেলেই কে বা কারা যেন গেছিল ফুন্টশোলিং, তাদের থেকে প্রাথমিক তথ্য জোগাড় করলাম। জয়গাঁও, ভুটান গেট, ইত্যাদি নামগুলোও সেই প্রথম শোনা। শিলিগুড়ি থেকে জয়গাঁওয়ের বাস যায় ময়নাগুড়ি বাইপাস দিয়েই, অর্থাৎ, আমাদের কলেজের সামনে দিয়েই। সুতরাং, একদিন সক্কাল সক্কাল আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে চান-টান সেরে রেডি হয়ে বাস ধরলাম জয়গাঁওমুখী। বাসে খানিক বাওয়ালও হল অবশ্য। কলেজ মোড় থেকে জয়গাঁওয়ের ভাড়া ছিল তিরিশ টাকা, আমরা যেহেতু ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছাত্র, আমরা পনেরো টাকার বেশি দেব না। আর কন্ডাক্টরও শুনবে না – বেসিকালি এটা ঐ রুটের অলিখিত নিয়ম ছিল, এখনও আছে কিনা জানি না, জলুর স্টুডেন্টদের জন্য কলেজ থেকে শিলিগুড়ি বিধান মোড় পর্যন্ত দশটাকার বাসভাড়া পাঁচটাকা নেওয়া হত। এখন শিলিগুড়ির দিকের বাসের নিয়ম জয়গাঁও রুটের কন্ডাক্টর নামবে কেন? কিন্তু যেভাবেই হোক, আমরা পনেরো টাকাই দিয়েছিলাম, এইটা মনে আছে।
খুব ঘটনাবিহীনভাবে আমাদের প্রথম বিদেশভ্রমণ ঘটে গেল। জয়গাঁওতে নামলাম, বাস থেকে নেমেই দেখি সামনেই একটা রাজকীয় স্টাইলের গেট, তার নাম ভুটান গেট, সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট ছোট চোখ বোঁচা নাকওলা দুজন ভুটানি সৈন্য, আমরা তাদের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে গেলাম ফুন্টশোলিং। গেটের অন্যপ্রান্তটা সম্পূর্ণ অন্যরকম, সাজানো গোছানো, আমরা পাঁচজন আর দশ পা এগোতেই দেখলাম পাহাড়ি রাস্তা শুরু হয়ে যাচ্ছে, হাঁটতে থাকলাম, খানিকটা ওপরে ওঠার পরে শহর হারিয়ে গেল, একটা ছোট মনাস্ট্রি দেখা গেল পাইনের জঙ্গলের মধ্যে, আমরা সেইখানে বসে একটু জিরোলাম। আর কিছু করার ছিল না, নিচে নেমে এলাম আবার, ভারত বর্ডারের একদম গা ঘেঁষে একটা ক্রোকোডাইল প্রজেক্ট ছিল মনে আছে, সেখানে কিছু কুমীর দেখলাম, সামনেই একটা সিনেমাহলএ গোবিন্দার সিনেমা চলছিল, ছোটে সরকার, এইসব দেখতে দেখতে আবার ভুটান গেট পেরিয়ে ভারতে ফিরে এলাম। জয়গাঁও। কাছেই একটা দোকানে ভরপেট কিছু খেয়ে উঠে দেখলাম তখনও অবধি জনপ্রতি খরচা হয়েছে উনচল্লিশ টাকা। উনচল্লিশ টাকায় বিদেশ ভ্রমণ! ভাবা যায়!
পেদো বলল, সবে দুপুর দুটো বাজে, এখন আর কলেজে ফিরে কী করব, জলদাপাড়া যাবি? শুনেছি এখান থেকে খুব কাছেই!
জলদাপাড়া!! সেই যেখানে গণ্ডার দেখা যায়! একশোবার যাব।
দুশো টাকা নিয়ে বেরিয়েছিলাম প্রত্যেকে, তার মধ্যে যা যা হতে পারে, সব করব। যে দোকানে দুপুরের খাবার খেলাম, সেখানেই জিজ্ঞেস করে জানলাম, বাসস্টপটার নাম মাদারিহাট, ওটাই জলদাপাড়ার এন্ট্রি। স্যাংচুয়ারির বাইরে আছে মাদারিহাট ট্যুরিস্ট লজ, ওখানে ডর্মিটরি রুম পাওয়া যেতে পারে, আর ভেতরে আছে হলং টুরিস্ট লজ, ওটা মূলত মন্ত্রীসান্ত্রীদের দেওয়া হয়, তবে খালি থাকলে এমনি টুরিস্টদেরও দেওয়া হয়।
বাস পেয়ে যখন মাদারিহাটের স্টপেজে নামলাম, তখন সন্ধে হব হব করছে, শীতকাল, দিন এমনিতেই ছোট। প্রথমে গেলাম হলং টুরিস্ট লজে, সেখানে রুম ছিল বটে, তবে রুমের ভাড়া শুনে ছিটকে যেতে হল। আমাদের স্বল্প বাজেটে হলং থাকা সম্ভব ছিল না স্বাভাবিকভাবেই। অতএব, ভেতরের চৌহদ্দী থেকে বেরিয়ে বাইরে মাদারিহাট ট্যুরিস্ট লজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে যখন পৌঁছলাম, তখন চারদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।
টুরিস্ট লজেও ঘরের ভাড়া আমাদের পাঁচজনের রেস্তর সাথে ঠিক খাপ খেল না। কী করা যায় তা হলে? ফিরে যাব?
লজেরই এক কর্মচারী, একটু দূরে জোরালো বালব জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলতে থাকা এক লোকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ঐ যে উনি, উনিই লজের ম্যানেজার, ওনাকে বলে দ্যাখেন, যদি কিছু ব্যবস্থা করার হয়, উনিই করতে পারবেন।
ব্যাডমিন্টনের তখন গেম চলছিল। আমরা ধীরস্থিরভাবে গেম শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করলাম, তারপরে ভদ্রলোককে অ্যাপ্রোচ করলাম। উনি একবার আমাদের মাথা থেকে পা অবধি মাপলেন, তারপরে বললেন একটা ডর্মিটরি রুম আছে, কিন্তু তাতে চারটিই খাট, আর তার একটা খাট ভাঙা, আর ভাড়া এক রাতের জন্য নশো টাকা।
হাতে পায়ে ধরবার অভিনয় করলাম (কলেজের ভাষায় যাকে বলত, মাল নামানো) – ম্যানেজার অল্প চেষ্টাতেই গলে গেলেন – এমনিতে তো ঐ ঘর কাউকে ভাড়া দেওয়া যেত না, বেশ, থাকো তোমরা, পাঁচশো টাকা দিতে পারবে?
আমি পেদোর দিকে, পেদো দুয়ারির দিকে, দুয়ারি দর্শনের দিকে তাকালাম, চোখে চোখে ইশারায় সাব্যস্ত হল, পাঁচশো টাকা পসিবল। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। ম্যানেজার আরও জানালেন, ঘোরাঘুরি করলে করতে পারো, কিন্তু রাত নটার সময়ে লজের গেট বন্ধ হয়ে যায়, তার আগে ফিরে আসবে। নটার পর কিন্তু হাজার ডাকলেও কেউ গেট খুলবে না।
ঘর অতি চমৎকার ছিল, কাঠের ঘর, কাঠের মেঝে, আমরা ঢোকামাত্র একজন কর্মচারী এসে পাঁচটা কম্বলও দিয়ে গেলেন। আর কী চাই?
হ্যাঁ চাই। দুপুরে জয়গাঁওয়ের খাওয়া অনেকক্ষণ হজম হয়ে গেছে, কিছু খেতে হবে। লজের খাবারের নিশ্চয়ই প্রচুর দাম হবে, চল্, বাইরে খাবারের খোঁজ করি।
সেই সময়ে জলপাইগুড়ির বিভিন্ন ছোট ছোট জনপদগুলো, যাকে গঞ্জ বলাই ভালো, একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যেত অন্ধকার হলে। সন্ধে সাতটার সময়ে মাদারিহাট মোড়ের সামনে এসে দেখলাম, সমস্ত দোকানপাট বন্ধ, চারদিক ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। কী করব? এদিকে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে।
প্রচুর খোঁজাখুঁজি করে একটা ঝোপের এড়ালে একটা গুমটি দোকান মত দেখলাম, বুড়ো তখন ঝাঁপ নামাচ্ছে। আমরা সেইখানে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। জানা গেল চা বাগানের কামিনদের জন্য চলে দোকানটা, বিকেলেই বন্ধ হয়ে যায়, এখন আর খাবার কী পাবে, খানিক শুওরের ঝোল আছে, আর বলেন তো কটা হাতে গড়া রুটি বানিয়ে দিই।
অমৃত খেয়েছিলাম সেই সন্ধ্যেয়, সে স্বাদ এই এত বছর পরেও মুখে লেগে আছে। রুটি আর নরম পর্কের ঝোল।
খাওয়া সেরে এতোল বেতোল ঘুরে আবার লজে ফেরত এলাম সাড়ে আটটা নাগাদ, ঘরভাড়া চুকিয়ে আর তেমন কিছু পয়সাও বাঁচে নি যে কাল স্যাংচুয়ারির ভেতর গণ্ডার দেখার প্ল্যান করব। জানিই না কত নেয়। যা হয় হোক, কাল সকালে উঠে দেখা যাবে, এই ভেবে আমরা জ্যাকেট ছেড়ে কম্বলের তলায় ঢোকার তোড়জোড় করছি, এমন সময়ে দরজায় ঠকঠক।
বাইরে লজের ম্যানেজার দাঁড়িয়ে। বিনা ভূমিকায় প্রশ্ন করলেন, কাল সকালের একটা বুকিং ক্যানসেল হয়েছে, তোমরা কাল এলিফ্যান্ট রাইড জাঙ্গল সাফারি করতে চাও, ভোরের স্লটে?
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, আমাদের অবস্থা তখন ঠিক লালমোহনবাবুর মত – আমার প্রত্যেকটা স্বপ্ন যে এইভাবে সত্যি হয়ে যাবে এ আমি ভাবতেইইই পারি নিইই!
আমাদের উত্তর দিতে হল না, ম্যানেজার অত্যন্ত স্মার্ট, আমাদের মুখের ভাষা পড়ে নিয়ে সাথে সাথে বললেন, সকাল সাড়ে চারটের সময়ে লোক এসে ডেকে দেবে – রেডি হয়ে নিও। সোয়া পাঁচটায় এলিফ্যান্ট রাইড। ও হ্যাঁ, দুটো হাতি, সত্তর টাকা করে লাগে, তোমরা সব মিলিয়ে একশো টাকাই দিও।
সারাদিনের ক্লান্তি কোথায় উড়ে গেল নিমেষের মধ্যে। সাড়ে চারটেয় যে উঠতে হবে, সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আমরা পাঁচজন সোল্লাসে চেঁচামেচি শুরু করে দিলাম। জাস্ট বিশ্বাসই হচ্ছে না যে, লজের ঘরে বসেই আমাদের জলদাপাড়ার সাফারি এইভাবে বুক হয়ে গেল!
সাড়ে চারটেয় লজের কর্মচারী পাঁচ গ্লাস চা নিয়ে এসে আমাদের জাগালেন। কমপ্লিমেন্টারি। চা খেয়ে আড়মোড়া ভেঙে রেডি হয়ে বাইরে বেরোতেই দেখলাম, একটা হুডখোলা জিপ দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জন্য। সেখানে গিয়ে বসতেই, আগের দিন সন্ধ্যে যে রাস্তা আমরা হেঁটে এসেছিলাম, সেই রাস্তাটুকু পেরিয়ে আমাদের নিয়ে এসে দাঁড়াল হলং টুরিস্ট লজের ঠিক সামনে। সেইখানে সিঁড়ি দিয়ে উঁচু পাটাতন করা, হাতির পিঠে চড়ার জন্য, আর দুটো পাটাতনের পাশে দুটো নয়, তিনটে হাতি দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অপেক্ষায়। দুটির মধ্যে একটি মা-হাতি, আর তৃতীয়টি সেই মায়ের ছা, ছটফটে একটা বাচ্চা হাতি।
না, গণ্ডার দেখা হয় নি সে-যাত্রা, কিন্তু যা দেখেছিলাম, তার সৌন্দর্য কোনও অংশে কম নয়। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাতির পিঠে চেপে চলেছি, মাঝে মাঝেই বাচ্চা শুঁড় দিয়ে মায়ের পা জড়িয়ে ধরছে, দুধ খাচ্ছে মায়ের, সামান্য বিরতির পর আবার চলা, ভিজে শাল সেগুনের পাতা আমাদের গায়ে বুলিয়ে যাচ্ছে চলার পথে, আমরা ভিজে যাচ্ছি ভোরের শিশিরে, হঠাৎ করে চারদিক আলো করে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারল ইয়াব্বড় একটা টকটকে লাল রঙের সূর্য। সে সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। যতটা পারছি, শুষে নিচ্ছি সে রূপ, সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে।
দুশো টাকার একটু বেশিই খরচা হয়েছিল সে-যাত্রা, কিন্তু তার জন্য কোনও দুঃখ ছিল না। মাদারিহাট থেকে কলেজ মোড় ফেরার সময়ে আর কন্ডাক্টরের সাথে ঝগড়া করি নি বাসভাড়া নিয়ে। আমাদের সফরসঙ্গী মাতালের কাছে একটু বেশি টাকা ছিল, তাই দিয়ে ফেরত এসেছিলাম।
******************************
(নামগুলো সব বদলানো কিন্তু, হ্যাঁ?)
স্যাটার নাম কী জন্য স্যাটা হয়েছিল, এতদিনে আর মনে নেই – সম্ভবত র্যাগিং পিরিয়ডে জানা গেছিল সে বাঁ-হাতি, সেই কারণেই তার নাম হয়ে গেছিলল্যাটা, আর ল্যাটা থেকে পরে হয়ে যায় স্যাটা।
আমাদের ব্যাচে ছিল আটটি মেয়ে। তাদের মধ্যে একজন ছিল পৌলমী। দক্ষিণবঙ্গের কোনও এক গ্রামে তার বাড়ি, উচ্চারণে “স”-এর আধিক্য ছিল। ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম সপ্তাহে সে আমাকে প্রকাশ্যে “অ্যাই সিকি, সোন্” বলে ডেকেছিল, কারণটা ছিল নেহাৎই নিষ্পাপ, কোনও একটা বই দেবার বা নেবার ছিল, কিন্তু সেই থেকে আমার নামের সাথে পৌলমীর নাম জুড়ে গেল। এবং কিছু বিরিয়ানি তৈরি হল। আগেই লিখেছিলাম, কলেজে, অন্তত আমাদের ইয়ার পর্যন্ত ছেলে এবং মেয়েদের ইন্টার্যাকশন ব্যাপারটা খুবই আনইউজুয়াল পর্যায়ের ছিল, ফলে কলেজের করিডরে কিংবা ক্যাম্পাসের রাস্তায় কোনও একটা ছেলে এবং একটা মেয়েকে একসাথে দেখা গেলে, কথা বলতে দেখা গেলে, সেগুলো নিয়ে বিভিন্ন ধরণের আলোচনা তৈরি হত, এবং সেগুলোর বেশির ভাগই শালীনতার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকত না।
তো, কলেজ লাইব্রেরির সামনে পৌলমীর আমাকে ডাকা নিয়েও হাল্কা গল্প তৈরি হল। এদিকে, আমি তখন সদ্য দাগা খেয়ে এসেছি। বাংলা কোচিং ক্লাসে কমলা রংয়ের সালোয়ার কামিজ আর ঘিয়ে রংয়ের সোয়েটারের সেই “না” বলার ঘা বুক থেকে তখনো মোছে নি। সেই সময়ে অন্য কোনও মেয়ের নামের সাথে নিজের নাম জড়িয়ে গেলে, কেমন একটা পাপ-পাপ ফিলিং হত। আদারওয়াইজ, পৌলমী মেয়েটা মন্দ ছিল না, বেশ মিশুকে, খুব মিষ্টি পানপাতা কাটিং মুখ, কেবল প্রস্থে ছিল আমারও অর্ধেক। … যাই হোক, আমি দেখলাম, পৌলমীর সঙ্গে আমার “কিছু নেই” – এটা মার্কেটে প্রতিপন্ন করতে গেলে লাভ তো হবেই না, উল্টে আওয়াজে আওয়াজে আমার জীবন ওষ্ঠাগত হবার চান্স আছে। অতএব, আমি উলটো প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করলাম। সমস্ত আওয়াজের জবাবেই আমি সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলাম, হ্যাঁরে, পৌলমীর ওপর আমার তো হেব্বি ব্যথা, কবে যে যাবো ওর সাথে দেখা করতে … ইত্যাদি ইত্যাদি।
দেখলাম, ফল হল। আওয়াজ আস্তে আস্তে কমে গেল।
ফিরে আসি স্যাটার গল্পে। তখন আমরা ফোর্থ ইয়ারে। সেখানে প্রত্যেকের জন্য একটা করে রুম। রুম না বলে খুপরি বলাই ভালো। ছ-ফুট বাই ছ-ফুট। একটা খাট, একটা টেবিল-চেয়ার, কাবার্ড, আর দাঁড়াবার জন্য একচিলতে জায়গা। ব্যস।
আমাদের চিরন্তন অভ্যেসমতো সন্ধ্যেটা কাটতো টাউনে ঘোরাঘুরি করে, বাওয়ালবাজি করে। পড়াশোনা শুরু হত রাত দশটার পর। সেদিন ছিল শনিবার। পরদিন ছুটি। সোমবার কিছু সেশন্যাল জমা দিতে হবে, বেশি রাত পর্যন্ত জেগে নামিয়ে দেওয়া যাবে, পরদিন তো রবিবার, সেই অভিপ্রায়ে স্যাটা এল আমার রুমে, রাতের খাওয়া সেরে।
সেশন্যালের কাজ খানিক এগোবার পরেই বোঝা গেল, তেমন কিছু না, ও কাল-করলেও-চলবে টাইপের। স্যাটারই দেখলাম, ঠিক মন নেই, কিছু একটা তোলপাড় করছে ওর মনের ভেতরে।
অবশেষে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ, লজ্জার মাথা খেয়ে, বিনা সিগারেটে বিনা মদে স্যাটা আমায় জিজ্ঞেস করেই বসল, জীনু, তু-তুই পৌলমীকে কি ভালোবাসিস?
এবার আমার ফ্যাক করে হাসার পালা। কিন্তু সামনে স্যাটার প্রায় কাঁদো-কাঁদো মুখ দেখে হাসতেও পারলাম না। কতকটা কনসোলেশনের ভঙ্গিতে বললাম, না-রে ভাই। আমার ল্যাজ অন্য জায়গায় বাঁধা আছে। আর যাই করি, ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের মেয়ের সাথে আমি প্রেম করব না। (এর অর্ধেক ঢপ, তখন আমি অন্যত্র ল্যাজ বাঁধবার চেষ্টা করছিলাম মাত্র, সেটা সফল হয় আরও এক বছর পর, তখন আমি অলরেডি জলপাইগুড়ি ছেড়ে চলে এসেছি)
স্যাটা কন্ভিন্সড হল। মনে মনে বোধ হয় ভাবল, এর কাছে মনের কথা বলা যায়। আমিই ওকে হাল্কা হাল্কা করে এই ঐ তাই জিজ্ঞেস করে করে ভেতরের আবেগ টাবেগ জাগিয়ে তুললাম। তখন কী আর জানতাম, সারারাত জাগতে হবে আমাকে ওর একতরফা প্রেমকাহিনি শোনার জন্য!
সত্যি সারারাত জেগেছিলাম। ধৈর্য ধরে শুনেছিলাম এক বাচ্চা প্রেমিকের একতরফা ভালোবাসার গল্প। বাচ্চাই বটে। ফোর্থ ইয়ারে পড়লেও স্যাটার বয়সোচিত ম্যাচিওরিটি তখনো আসে নি, অথবা, কে জানে, প্রেমে পড়লে অনেক ম্যাচিওর্ড ছেলেও ইমম্যাচিওর্ড হয়ে যায়। হয় তো … হয় তো ইমম্যাচিওর্ড শব্দটাও ঠিক হল না, আসলে ছেলেটা ছিল বড্ড সরল মনের। … সেই কবে হংকং মার্কেটে যাবার দিন বাসস্ট্যান্ডে দেখেছিল পৌলমীও ঐ একই জায়গায় যাবার জন্য রেডি, ও পৌলমীকে টিকিট কেটে দিয়েছিল বাসে, পৌলমী তাতে মিষ্টি হেসে থ্যাঙ্কিউ বলেছিল, তারপরে ফেরার পথে ও পৌলমীকে লেডিজ হস্টেলের গেট অবধি পৌঁছে দিয়েছিল, কিন্তু মনের কথা বলি-বলি করেও বলতে পারে নি, …
…শুনতে শুনতে মনের মধ্যে অনেক কিছু ফ্ল্যাশব্যাক চলছিল। ক্লাস টুয়েলভে তুলসীবাবুর ব্যাচে, সেই কোনো একজনকার হাসি দেখে, তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে, “কটাক্ষ” কথাটার মানে অনুভব করতে শিখেছিলাম, কতদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিস করেছিলাম, কেউ জানতে পারে নি, কেউ না, তবু বলতে পারি নি, … হুবহু মিলে যাচ্ছিল। তফাৎটা শুধু চার পাঁচ বছরের।
স্যাটাও বোধ হয় এত ভালো শ্রোতা এর আগে কখনও পায় নি। ইন ফ্যাক্ট সেই বয়েসে আমার ভীষণ ধৈর্য ছিল, আর প্রেমকাহিনি শুনতে কার না ভালো লাগে? শুনছি, বুঝতে পারছি যে-সব ইনস্ট্যান্সের উদাহরণ দিয়ে ও আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করছে যে, পৌলমীও নাকি মনে মনে ওকেই চায়, সেগুলো একেবারেই অর্থহীন, কিন্তু সে-সব কথা বলে তার হ্যালু কাটাতে ইচ্ছে হল না। আপাত-অর্থহীন নানা অ-ঘটনার ঘটনাবলীতে যখন গল্প থামল, ঘড়িতে তখন বাজে সকাল সাড়ে পাঁচটা। আকাশ লাল করে সূর্য উঠছে। রোববারের সকালটা ভোগে গেল।
আমরা দুই বিরহী প্রেমিক চার বছরের মাথায় সেই সকালে প্রথমবারের জন্য মর্নিং ওয়াক করতে বেরোলাম। চা-বাগানের মাথায় হাল্কা লেপের মত জড়িয়ে আছে কুয়াশা, তার বুক চিরে হুশ্-হুশ করতে করতে বেরিয়ে গেল আসামগামী কোনও এক্সপ্রেস ট্রেন, গুয়াহাটি রাজধানী, কিংবা সরাইঘাট, অথবা তিস্তা-তোর্সা ঢুকল বোধ হয়। আমরা লেডিজ হস্টেলের দিকের রাস্তাটা ধরলাম। সারা ক্যাম্পাস ঘুমিয়ে, কেউ দেখবে না, কেবল কিছু স্বাস্থ্যসচেতন প্রফেসরদের সাথে দেখা হয়ে যাওয়া ছাড়া, তা, তাতে আর কবে ফোর্থ ইয়ার ভয় পেয়েছে!
লেডিজ হস্টেলও ঘুমিয়ে ছিল, স্বাভাবিকভাবেই। পাশ দিয়ে আমরা বেরিয়ে গেলাম, স্যাটা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। তারপরে কলেজ মোড়ে গিয়ে পাঁউরুটি আর ঘুগনি দিয়ে ব্রেকফাস্ট, ফিরে এসে যে-যার রুমে এসে ঘুম।
… বলবার মত বিশেষ কোনও ঘটনা ছিল না এটা, তবু, টুকরো টাকরা স্মৃতির মতই সেই রাতটা মনে রয়ে গেছে। চারটে বছরের অনেকগুলো রাতের মধ্যে একটা রাত।
******************************
কলেজে দু খেপে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। কালচারাল আর সোশাল। কালচারাল শুধু কলেজের মধ্যে, গান অন্তাক্ষরী স্কিট এক্সটেম্পো ডিবেট। কিন্তু মুখ্য আকর্ষণ ছিল সোশাল। সোশালের নাম জেকল্যাট বা জেকলে, অনুষ্ঠানের বিষয়গুলো একই হত, কেবল সোশাল হত আশেপাশের বিভিন্ন কলেজের ছেলেমেয়েদের সাথে নিয়ে। ‘আশেপাশের বিভিন্ন কলেজ’ কথাটা খুব অনায়াসে বলে দিলেও, সবার মতই আমরাও জানতাম, সব কলেজের জন্য অপেক্ষা করতাম না আমরা, আসল সোশাল জমে উঠত পাহাড়ের ওপর থেকে দেবীরা নেমে এলে।
এলসি ড্যার্জ। অর্থাৎ কিনা লোরেটো কলেজ দার্জিলিং। তারা ছিল সোশালের আসল আকর্ষণ। তাদের জন্য স্পেশাল খাতিরযত্ন হত, যে হেতু প্রতি বছর সোশালের দায়িত্বে থাকত থার্ড ইয়ার (নাকি ফোর্থ ইয়ার?), ফলে সেই ইয়ারের সোশাল কমিটির ছেলেপুলেরা এলসি ড্যার্জদের আশেপাশে প্রায় বডিগার্ডের মতন ঘোরাঘুরি করত।
রেগুলার ইভেন্টের সাথে থাকত কলকাতার কোনও গায়ক গায়িকা, বা সেই সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড কাউকে নিয়ে এসে এক রাতের জন্য প্রোগ্রাম। তো, কলেজে থাকতে শুনেছি লোপামুদ্রা, জগন্নাথ-ঊর্মিমালা, শিলাজিৎ, ইন্দ্রনীল সেন, মিস জোজো এবং ক্যাকটাস।
এলসি ড্যার্জ এবং অন্যান্য কলেজের মেয়েদের জন্য প্রিন্সিপাল কোয়ার্টার খুলে দেওয়া হত (আমাদের কলেজে প্রিন্সিপাল ছিল না, মানে পোস্টটি বহুকাল ধরে ভ্যাকেন্ট ছিল, ফলে প্রিন্সিপাল কোয়ার্টারেও কেউ থাকত না), আর ছেলেদের জায়গা হত এক ও দুই নম্বর হস্টেলের কমন রুমে। চার পাঁচদিনের জন্য কমন রুম আগন্তুকদের জন্য রিজার্ভড থাকত।
সেই বছর, আমাদের দুই নম্বর হস্টেলে্র কমন রুমে, শিলিগুড়ি পলিটেক্নিকের একটি ছেলের মানিব্যাগ খোয়া যায়। সে বাইরে কোথাও হারিয়েছিল, নাকি কমন রুমের ভেতর থেকেই হাপিশ হয়, মনে নেই, অর্গানাইজার হিসেবে থার্ড ইয়ার সোশাল কমিটির ছেলেরা দোষী সাব্যস্ত করে হস্টেলের নাইটগার্ড বিজলিদা-কে। কোনও প্রমাণ ছিল না, সেই যুগে সিসিটিভি বলেও কিছু এক্সিস্ট করত না, স্রেফ সন্দেহের বশে, একঘর বাইরের ছেলেদের সামনে, নিজেদের “সম্মানরক্ষা”র তাগিদে হস্টেলের মেন গেটের সামনে নির্দয়ভাবে পেটানো হয় কলেজে বহুদিনের পরিচিত বিজলিদা-কে। কেউ তাকে ডিফেন্ড করতে এগিয়ে আসে নি।
সারারাত মার খেয়ে বিজলিদা পড়ে ছিল হস্টেলের গেটের সামনে। পরে বোধ হয় কেউ তাকে হাসপাতাল নিয়ে যায়, দুদিন পরে বিজলিদাকে যখন দেখেছিলাম, তখন তার একটা চোখ বীভৎসভাবে ফুলে বুজে আছে, একটা হাতে ব্যান্ডেজ।
সেই মানিব্যাগ আর পাওয়া যায় নি, পাবার কথাও ছিল না, শিলিগুড়ি পলিটেকনিক পরের দিনই আমাদের হস্টেলের কমনরুম ছেড়ে শিলিগুড়ি ফেরত চলে যায়, হস্টেল সুপার মারফৎ কলেজ রেজিস্ট্রারের কানে ওঠে এই ক্যাঙারু কোর্টের বিবরণ। শাস্তির কথা উঠেছিল, কিন্তু কোনও কারণে তার পরে আর কারুরই শাস্তি হয় নি, কেবল ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় অর্গানাইজারদের।
******************************
আরো দুজনের কথা বলি। আমাদের ব্যাচের নয়, কিন্তু আমাদের সময়ের জলুর গল্প, কাইন্ড অফ অসম্পূর্ণ এদের গল্প ছাড়া।
সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি বোধ হয় তখন। একদিন রমাবৌদি এসে আমায় বলল, জীনু ফোর্থ ইয়ার হস্টেলে চল্, একজনকার সাথে আলাপ করিয়ে দেব, রফিদা। তুই তো গান টান নিয়ে থাকিস, মস্তি হবে।
রমাবৌদি ছিল খেলার জগতের লোক, গানের জগতের নয়। ফোর্থ ইয়ারে ও আমাদের কলেজের স্পোর্টস সেক্রেটারি হয়েছিল। কিন্তু ঐ রফিদার সাথে আলাপ করিয়ে দেবার ব্যাপরে ওর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। রফিদার আসল নাম কী ছিল মনে নেই, আমাদের তুলনায় বেশ খানিকটা সিনিয়রই ছিল, মানে, আমরা তাকে কলেজে কোনওদিন দেখি নি, আমরা যে বছর কলেজে ভর্তি হই, সেই বছরই রফিদা পাস করে বেরিয়ে ফিলিপ্স জয়েন করেছিল। কিন্তু কোনও কারণে রফিদা মাঝে মাঝেই জলপাইগুড়ি আসত; আর জলপাইগুড়ি এলেই হস্টেলে আসা তার মাস্ট ছিল।
সেই রকমই একবার রফিদার সাথে আলাপ হল, রফিদা তখন ভক্তজনপরিবেষ্টিত হয়ে বসে গুলতানি মারছে। খানিক বাদেই শুরু হল তার গান। আর কেউ না, মহম্মদ রফিরই গান সে গাইত, আর পুরো মনে হত আমাদের সামনে স্বয়ং রফিই যেন গান গাইছেন। গান শেখা নেই, তালিম নেওয়া গায়ক নয়, কিন্তু সেই সন্ধ্যেয় প্রথম শুনলাম যখন, সুহানী রাত ঢল চুকি হ্যায়, না জানে তুম কব আওগে, কী বলব, পুরো রুমটার পরিবেশ বদলে গেল লহমায়। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, চারপাশের সবকিছু মুছে গেল, কেবল সুরটা ভেসে ভেসে চলল বাইরে বড় মাঠের প্রান্তে জ্বলতে থাকা হ্যালোজেনের হলুদ আলোর দিকে, সেই আলোর রেশ ছাড়িয়ে আরো পেছনে, অন্ধকার চা-বাগানের ভেতরে।
গান চলতে থাকল। ও দুনিয়া কে রাখওয়ালে, খানিক পরে ইয়াদ না জায়ে বীতে দিনোঁ কি, তারপরে আরো আরো গান।
এই রকম আরেকজন ছিল লতাদা। এ লতা মঙ্গেশকরের গলায় গান গাইত, এবং গাইত একজন ছেলে হয়ে। প্রথম শুনেছিলাম যখন, বিশ্বাস করি নি, যত গলা সরু করেই গাক, একজন ছেলে লতা মঙ্গেশকরের গলায় কী করে গাইবে? ভেবেছিলাম, নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ওভারহাইপ্ড। কিছু হলেও একটু বিকৃতি তো নজরে আসবেই! তা ছাড়া লতা মঙ্গেশকরের নিজের স্কেলটাও অন্যান্য গায়িকাদের থেকে বেশ উঁচুতে, এফ শার্প না কী যেন, সচরাচর কেউ ঐ স্কেলে গায় না। সেই স্কেলে একজন ছেলের পক্ষে গাওয়া তো একেবারেই সম্ভব নয়। লোকে নিশ্চয়ই বাড়িয়ে বলছে।
আমি যে কতটা ভুল ভেবেছিলাম, তা বুঝেছিলাম যেদিন সামনাসামনি বসে লতাদার গান শুনলাম। লতাদা ছিল আমাদের রেসপেক্টে ফোর্থ ইয়ার। হস্টেলে বসেই শুনলাম – যাবার বেলায়, পিছু থেকে ডাক দিয়ে, কেন বলো, কাঁদালে আমায়। … সামনে, মুখোমুখি বসে থেকেও, স্রেফ চোখটা বুজে থাকলে যে-কেউ মনে করবে খুব মিষ্টি সুরেলা গলার একটা মেয়ে গাইছে। একটা বাইশ তেইশ বছরের ছেলের যে এমন সুন্দর মেয়েদের গলা হতে পারে, এ নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করা যাবে না।
যাঁরা গান-টান নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা জানেন, গলার মাইক-ফিটনেস বলে একটা ব্যাপার থাকে। স্বয়ং মহম্মদ রফির গলা নাকি ছিল বেশ ফ্যাঁসফেঁসে। কেবল মাইক্রোফোনের সামনে পড়লে সেই গলায় জাদু খেলে যেত, পুরো ভারত যার প্রেমে পড়ে যেত। কিন্তু লতাদার বেলায় দেখেছিলাম এই এক অদ্ভুত ব্যাপার। সামনাসামনি বসে তো মিষ্টি লেগেছিল বটেই, প্রথম মাইকে তার গান শুনি কলেজের কালচারাল প্রোগ্রামে; গেয়েছিল আরতি মুখোপাধ্যায়ের “এক বৈশাখে দেখা হল দুজনায়”। সে গানের মাধুর্য যেন সবকিছুর ওপরে ছিল। গোটা অডিটোরিয়াম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিল সেই গান। গলার মিষ্টত্বের যেন কোনও শেষ থাকত না লতাদা যখন মাইক্রোফোনের সামনে গাইত।
লতাদা, রফিদা, এরা পরেও এসেছিল কলেজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, গান গাইতে। কলেজ ছাড়ার পরে আর, যা-হয়, যোগাযোগ রাখা হয়ে ওঠে নি।
… চলবে