জলু – দশম (শেষ) পর্ব

নবম পর্বের পর

পর পর ন’টা পর্ব লিখে ফেলার পর মনে হচ্ছে, এবারে একটা কোথাও ইতি টানা ভালো, না হলে এ ঠিক তেমন কোনও লেখা হচ্ছে না, ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে না, নিতান্তই একজনকার ঘটনাবিহীন মনোলগ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই, জলুর স্মৃতিচারণ এই পর্বেই শেষ করা মনস্থ করছি।

এ ধারাবাহিক আমি এর আগেও শুরু করেছিলাম, গুরুচণ্ডালির পাতায়, সেবারেও শেষ করা হয়ে ওঠে নি, এবারেও এ লেখা আর আগিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। সত্যি কথা বলতে, বিশাল কিছু মধুর স্মৃতি বা নস্টালজিয়া আমার নেই চার বছরের জলপাইগুড়ি বাসের ওপর। ঠোক্কর খেতে খেতে ফোর্থ ইয়ারে কোনওরকমে উঠে পড়া, আর তারপরে বিভিন্ন ধরণের চিন্তা, আতঙ্ক ভিড় করে আসা তিন নম্বর হস্টেলের একলা রুমের মধ্যে, এবং ক্রমশ রিয়েলাইজ করা, গত তিন বছরে যা যা পড়েছি, তার একটা বর্ণও মনে নেই। স্রেফ পাস করার তাগিদে পড়ে গেছি এবং পরীক্ষায় পাস করেছি। মাঝে সেকেন্ড ইয়ারে ইলেকট্রনিক্সে সাপ্লি খেয়েছিলাম, সে-ও কারণ অন্য ছিল, বিশেষ প্রয়োজনে বাড়ি যেতে হয়েছিল, ফেরার সময়ে ট্রেন বিশাল লেট করে হাফ ইয়ার্লি ইলেকট্রনিক্স পরীক্ষাটাই মিস করে গেছিলাম – পুরো তিরিশ নম্বর, পরে অ্যানুয়ালে আর পাস মার্ক তোলার ক্ষমতা আমার ছিল না।

ফোর্থ ইয়ারে উঠে বুঝতে পারছিলাম, ছাত্রজীবন ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে, এর পরে চাকরিবাকরির একটা চেষ্টা করতে হবে। ইঞ্জিনীয়ারিং পড়েছি, তো ইঞ্জিনীয়ারিং লাইনেই চাকরি খুঁজতে হবে। কিন্তু চাকরি কোথায়? মেকানিকাল ইলেকট্রিকালের ছেলেমেয়েরা গেট পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করল, আমার মাথায় ভূত চাপল, আমি ম্যানেজমেন্ট পড়ব। ক্যাট আর ম্যাট – এই দুটো পরীক্ষা তখন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে, তার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। আইএমএস থেকে স্টাডি মেটিরিয়াল এল, তাতে ইংরিজি শব্দের লিস্ট, এইগুলো নাকি পাখিপড়ার মতন করে মুখস্থ করতে হবে।

আমি প্রথম পাতার পরে আর এগোতে পারি নি। ইংরিজিতে আমার চিরকালের বিষম ভয় ছিল। গত তিন বছরে ঠোক্কর খেয়ে কোনওরকমে ইংরিজি টেক্সটবুক পড়া অভ্যস্ত করেছি, পরীক্ষার খাতায় লিখতেও পেরেছি যা হোক কিছু, কিন্তু বলা, বা শোনার মত কনফিডেন্স, ফোর্থ ইয়ারে উঠেও আমার হয় নি।

আমি একা ছিলাম না, এই রকম আমাদের ব্যাচের, আমাদের আগের বা পরের ব্যাচের অনেকেরই অবস্থা ছিল। ইংরিজি বলতে গেলে পেটে ডুবুরি নামাতে হত। ইংরিজিতে সড়গড় হবার স্বপ্নে ইংরিজি খবরের কাগজ নেওয়া শুরু করেছিলাম সেকেন্ড ইয়ার থেকে, তাতেও বিশেষ কিছু উন্নতি যে হয় নি, সে টের পেয়েছিলাম ফোর্থ ইয়ারে প্রোজেক্ট অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করতে গিয়ে।

পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন সংক্রান্ত কিছু একটা রদ্দি মার্কা প্রোজেক্ট পেয়েছিলাম করার জন্য, কী ছিল – আগুপিছু কিচ্ছু মনে নেই এখন, কেবল মনে আছে, ‘ডেটা কালেকশনের’ জন্য একবার গেছিলাম সল্লেকে, বিদ্যুৎ ভবনে। চীফ ইঞ্জিনীয়ার নিজের কেবিনে বসালেন, আমাকে ইংরিজিতে প্রশ্ন করলেন, আমি বুঝতেও পারলাম, উত্তরটাও জানি, কিন্তু উত্তরটা ইংরিজিতে দেবার মতন কনফিডেন্স পেলাম না – বাংলাতেই উত্তর দিলাম। উনি বাঙালিই ছিলেন। চীফ ইঞ্জিনীয়ারের ভুরুটা একটু কোঁচকালো, পরের প্রশ্ন ইংরিজিতে, আর আমার উত্তর, আবারও বাংলায়। উত্তর নির্ভুল, কিন্তু ইংরিজি বেরোল না মুখ দিয়ে।

তিন নম্বর প্রশ্নের বাংলায় উত্তর পেয়ে চীফ ইঞ্জিনীয়ার এক রকম অপমানই করে বসলেন আমাকে। এক ফোঁটা ইংরিজিতে কথা বলার মুরোদ নেই, তুমি আর কদিন বাদে ক্যাম্পাসিংয়ে বসবে, চাকরি পাবে? স্বপ্ন দেখা খুব সোজা হে, তোমার নলেজ, তোমার প্রোজেক্টের রিপোর্ট কোনও কাজে আসবে না যদি ইংরিজিতে কথা না বলতে পারো।

মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেছিলাম। সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমাকে ইংরিজিতে কথা বলা শিখতেই হবে। দরজা বন্ধ করে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাথে নিজে কথা বলা শুরু করলাম। যা খুশি – যে কোনও টপিক। একটু একটু করে জড়তা কাটতে লাগল।

কিন্তু জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, সে তো কলকাতা থেকে ছশো কিলোমিটার দূর! কোনও কোম্পানি আসে না। ঝম্পু, অর্থাৎ প্রোফেসর শ্রী জ্যোতির্ময় ঝম্পটি বলেছিলেন বটে, ‘রতনকে একটা খবর দিয়ে দিব নে, ট্রাক নিয়ে আ’সে ইঞ্জীনিয়ার নিয়ে যাবে, ক্কী’? রতন অর্থাৎ রতন টাটা। টাটা বলতে তখনও আমরা আশা করতাম টাটা স্টিল বা টাটা পাওয়ার। টিসিএসের স্বপ্নও তখনও আমরা দেখি নি। তো, ট্রাকও এল না, টাটার কোনও চাকরির ইন্টারভিউয়ের অন্তত ডাকও এল না। ইন্ডিয়ান অয়েলের পরীক্ষার জন্য ফর্ম ভরে ছবি লাগিয়ে খামে ভরে পাঠিয়েছিলাম, উত্তর আসে নি। এনটিপিসি, উত্তর আসে নি, এনএইচপিসি, উত্তর আসে নি। পুজোর ছুটিতে বাড়ি গিয়ে ডিসির সঙ্গে কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে মীট করলাম, তারপরে সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে ট্র্যাঙ্গুলার পার্ক পেরিয়ে গড়িয়াহাট মোড় পেরিয়ে ঢাকুরিয়া যাদবপুর প্রিন্স আনোয়ার শা রোড – যত জব কনসাল্টেন্সি এজেন্সির ঠিকানা জোগাড় করেছিলাম, সব জায়গায় একটা করে সিভি ড্রপ করে এসেছিলাম। সেই যে কোন কবি বলেছিলেন, হেঁটে দেখতে শিখুন, এক রকম হেঁটে দক্ষিণ কলকাতা চিনেছিলাম সেই একদিনে।

একটা এজেন্সি থেকেও ডাক আসে নি। ডিসেম্বরে আবার বাড়ি গেলাম, ক্যাট পাবো না জানাই ছিল, তাও পরীক্ষা দিতে গেছিলাম, ম্যাট দিলাম, সাথে আরো দুটো একটা – শেষ পরীক্ষাটার সীট পড়েছিল হিন্দু স্কুলে, চমৎকার চমৎকার অনেকগুলো পাজল সলভ করতে দিয়েছিল সেখানে, ইলেকট্রিকালের বিন্দুবিসর্গ ছিল না সেই পরীক্ষায় – সেটা খুব ভালো দিয়েছিলাম, দিয়ে এক বন্ধুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে নন্দন। টিকিট কেটে সেক্সপীয়ার ইন লাভ দেখলাম, আবার হাঁটতে হাঁটতে বাবুঘাট, লঞ্চ ধরে হাওড়া, ট্রেন ধরে বাড়ি – এক রকম শেষবারের মত কলকাতা উপভোগ করে নিচ্ছিলাম। আর কমাস, আর কটা মাস পড়েই আমার ইঞ্জিনীয়ারিং পড়া শেষ হবে, তার পরে নিকষ অন্ধকার। কী হবে, জানি না। কীভাবে কোথা থেকে চাকরি খোঁজা শুরু করব, কোনও আইডিয়া ছিল না।

শিলিগুড়ি থেকে একদিন ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের পরীক্ষার ডাক এল প্রতি বছরের মত। থাপাদা বাসে করে আমাদের নিয়ে গেল মাটিগাড়া না শালুগাড়া, কোন একটা ক্যাম্পে। কঠিন কঠিন প্রশ্ন , জঘন্য উত্তর দিয়ে বসে রইলাম, খানিক বাদে এক অফিসার এসে এক এক করে নাম ডাকতে লাগলেন – যাদের নাম ডাকা হবে, তারা সবাই এদিকে এসে দাঁড়াও।

আমার নামও ডাকা হল, উত্তেজনায় বুক ধুকপুক করছে, তা হলে কি উতরে গেলাম এই রাউন্ডে?

ক্রমশ দেখলাম, আমার দিকে প্রায় সকলেই, উল্টোদিকে চারজন বাকি রইল। এইবারে অফিসার বললেন, যাদের নাম ডাকলাম, তারা সবাই ফেল করেছো, তোমরা বাসে চেপে কলেজে ফেরত যাও, এই চারজন পরের রাউন্ডের জন্য ওয়েট করো।

হিউমিলিয়েশন। কিন্তু, কী করা যাবে, যারা অকৃতকার্য হয়, তাদের জন্য হয় তো এই রকমেরই ব্যবহার লেখা থাকে। ধীর পায়ে বাসে উঠে বসলাম, চুপচাপ কলেজ ক্যাম্পাসে ফেরত গেলাম। 

বাকি চারজনও পরের রাউন্ডেই কেটে গেছিল। ও প্রত্যেক বছরেই হয়। ডাকে, তারপরে কাউকেই নেয় না।

হ্যাঁ, ক্যাম্পাসে দু একটা কোম্পানি এসেছিল। টপাররা বসার চান্স পেয়েছিল, দশ বারো হাজার টাকার চাকরির অফারও পেয়েছিল। আমি টপারদের ধারেকাছেও ছিলাম না, ফলে আমার চান্স পাবার কোনও কথাই ছিল না।

ক্যাটের রেজাল্ট বেরোল, পাই নি। ম্যাটের রেজাল্ট বেরোল, হ্যাঁ, সেখানে একটা ভালো রেজাল্ট হয়েছে বটে, বেশ কয়েক জায়গা থেকে ডাক এল – আবার বাড়ি গেলাম, কিন্তু ইনস্টিট্যুটগুলোর হাল দেখে বিতৃষ্ণা জাগল। এই রকম ভাঙাচোরা বাড়িতে, চটের বস্তা টাঙানো জানলায় ম্যানেজমেন্টের ক্লাস হয়? এরা কারা?

ফিরে এলাম। সামনে গভীর অন্ধকার, সে জেনেই ফাইনাল পরীক্ষা দিতে বসলাম। পরীক্ষা শেষ হল এক সময়ে – কী লিখেছি পরীক্ষার খাতায়, কী লিখি নি, কিছুই আর স্মৃতিতে নেই, তখন যেন আর কোনও কিছুরই পরোয়া ছিল না।

ক্লাস টুয়েলভে ওঠার মুখে সেই যে কমলা সালোয়ার কামিজ আর ঘিয়ে রঙের সোয়েটার পরা মেয়েটির মুখে রূঢ় ‘না’ শুনে আমার প্রথম প্রেমের সম্ভাবনা ভেঙে গেছিল, তার পরে দীর্ঘদিন আর সে রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা করি নি। কলেজেপ্রেম হবার পরিবেশ ছিল না, সে রকম কাউকে মনেও ধরে নি। চিঠি লিখতাম আমার সেই ইলেভেল টুয়েলভের টিউশনের বন্ধু বান্ধবীদের। চিঠির উত্তরদাতার সংখ্যা কমতে কমতে ক্রমশ ঠেকেছিল দুটিতে। দুজনেই বান্ধবী। তাদের একজনের ছায়া আমার মনের ওপর পড়তে লাগল ধীরে ধীরে। হুগলি-কলকাতায় গেলেই তার সাথে দেখা করতাম, মনে মনে তাকে চাইতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু মুখ ফুটে আর বলার সাহস ছিল না, প্রথম প্রত্যাখ্যানের ঘা তখনো মোছে নি। যদিও এখন আমি ফোর্থ ইয়ার, এখন আমার বাইশ বছর বয়েস, পেছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারি সতেরো বছর বয়েসে সে অনুভূতি প্রেম ছিল না, নিতান্তই ভালোলাগা, আগুপিছু কিছু না ভেবে ভালো লেগে যাওয়া, মুখের ওপর ‘না’ বলে আসলে আমার উপকারই করেছিল মেয়েটি, কিন্তু এবার যখন বুঝতে শুরু করলাম, আমার নতুন অনুভূতি, আর কিছু নয়, সত্যিকারের ভালোবাসা, তখন আর দ্বিতীয়বারের জন্য সাহস ফিরে পেলাম না। এক তো আগের অভিজ্ঞতা, আর দ্বিতীয়, আমার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কোন মুখে তাকে বলব, আমি ভালোবাসি?

সে কেমিস্ট্রি অনার্স পড়ে ততদিনে বেলঘরিয়াতে সরকারি কমপিটিটিভ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, আমি ফোর্থ ইয়ারের মেশিনস আর পাওয়ার সিস্টেমসের বইয়ের দুর্বোধ্য ইংরিজিতে খেই হারিয়ে ধুত্তেরি বলে সাদা ফুলস্কেপ কাগজ টেনে বসছি তাকে আরও একটা চারপাতার চিঠি লিখব বলে।

ক্রমশ পরীক্ষা শেষ হল। ক্যাম্পাস ছাড়ার পালা। অনেকের চোখ ছলছল, বন্ধুরা স্ক্র্যাপবুক জোগাড় করে সবাই সবাইকার বাড়ির নম্বর টুকছে, বিদায়ী কমেন্ট লিখছে।

আমি তখন যেতে পারলে বাঁচি। আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না জলু ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে, একটা বিশাল বড় শূন্য নিয়ে ফিরছি। বাবা-মা-দিদি এসেছিল শেষবেলায়, সবাই মিলে সিকিম গেলাম চার দিনের জন্য। গ্যাংটক। শেষবারের মত ছাত্রজীবন এনজয়। গেট পরীক্ষাও দিই নি যে মাস্টার্স পড়তে যাবো। স্টুডেন্ট লাইফ তা হলে, এখানেই শেষ।

ট্রাঙ্ক গুছিয়ে শেষবারের মত যতীনদা, নবীনদাদের বিদায় জানিয়ে রিক্সায় উঠে বসলাম। তিস্তা আসে জলপাইগুড়ি রোডে, আর তোর্সা আসে জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনে। দুটো আলাদা ট্রেন রাণীনগর স্টেশনে গিয়ে কাপলিং করে তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস নাম নিয়ে শিয়ালদার দিকে যায়।

আমরা উঠে বসলাম তিস্তায়। মনের মধ্যে আমার একরাশ শূন্যতা, আর চিন্তা। এর পর কী? এর পর কোথায়? কীভাবে? কী লাভ হল এখানে চার বছর পড়ে?

পরদিন ব্যান্ডেল পৌঁছলাম ছ ঘন্টা লেটে। ও লাইনে এসব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। বাড়ি ঢুকলাম যখন, তখন বেলা দুটো। লেটারবক্স খুলতেই একটা হলুদ রঙের চিঠি বেরিয়ে এল। ওপরে একটা লোগো। আইআইটি খড়গপুর।

সেই যে ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় হিন্দু স্কুলে পরীক্ষা দিতে বসেছিলাম, যেখানে চমৎকার চমৎকার সব পাজল এসেছিল? সেটা ছিল আইআইটির পরীক্ষা। খড়গপুর আইআইটি প্রথমবারের জন্য হাইব্রিড মোডে একটা কোর্স শুরু করছে, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা ইন ইনফরমেশন টেকনোলজি, তার প্রথম ব্যাচের পরীক্ষায় বসেছিলাম, তাতে উত্তীর্ণ হয়েছি, অর্থাৎ, এবার আমি আইআইটির স্টুডেন্ট!

মুহূর্তের মধ্যে মনের অনিশ্চয়তার মেঘ উড়ে গেল, অথৈ জলের মধ্যে কুটো আঁকড়ে ধরার মত করে সেই হলুদ রঙের খামটাকে আঁকড়ে ধরলাম – না, আর আমার জলুকে ভুলে যেতে সমস্যা হবে না। নতুন ভাবে শুরু করব। সময় বদলাচ্ছে, ইলেকট্রিকালে তো কিছু হল না, চারদিকে এখন নতুন ট্রেন্ড উঠেছে, কম্পিউটার, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ইমেল – আমি সেই জগতে ঢুকতে যাচ্ছি, আইআইটির শিক্ষা নিয়ে। সমস্ত সম্ভাবনা যখন প্রায় শেষ হয়ে গেছিল, তখন এমন একটা সম্ভাবনা এসে গেল আমার হাতে, যার থেকে ভালো কিছু হতেই পারে না।

(শেষ)

ফার্স্ট, সেকেন্ড আর থার্ড ইয়ারের কলেজ ম্যাগাজিন কমিটি। 



শেষ হবার পরেও কিছু থেকে যায়। ফোর্থ ইয়ারের একটা সাবজেক্টে আমি আবার ফেল করেছিলাম, আঠাশ নম্বর পেয়ে। সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে আমাকে আবার জলু যেতে হয়েছিল, সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা দিতে। কীভাবে সে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগের রাতে আমি হাতে পেয়ে গেছিলাম, এবং এক ঝলক দেখেই বুঝে গেছিলাম যে, এটা হাতে না পেলে আমি আবারও ফেল করতাম, এবং আইআইটিতে পড়ার সম্ভাবনারও আমার ওখানেই ইতি হত – সে অন্য এক গল্প। মোদ্দা কথা, দ্বিতীয়বারে আর ফেল করি নি। আর কখনও জলুমুখো হবার প্রবৃত্তি হয় নি তার পরে।

চার বছরের জলপাইগুড়ি সরকারি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের শিক্ষা, বনাম এক বছরের আইআইটি খড়গপুরের কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের শিক্ষা। দুটোতে যে কী আকাশ পাতাল তফাত, তা আমি পরের এক বছরে বুঝেছিলাম। জলপাইগুড়ির ঐ চার বছর আমার গোটা জীবনে কখনো কাজে লাগে নি, স্রেফ একটা কাগজের টুকরো পাবার জন্য জীবনের চারটে বছর আমি ওখানে নষ্ট করেছিলাম বলে আজ মনে করি, উল্টোদিকে আইআইটির সেই এক বছরের শিক্ষায় আমি আজও করে খাচ্ছি। আমরা ছিলাম পিজিডিআইটির প্রথম ব্যাচ, সল্টলেকের এইচ-সি ব্লকে আইআইটির কলকাতা স্টেপ-ক্যাম্পাসে আমাদের ক্লাস হত … এখনও হয় সম্ভবত। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম খড়গপুরের কয়েকজন রত্নকে – পি পি চক্রবর্তী (এখন যিনি আইআইটির ডিরেক্টর, এবং একটি বিগড়ে যাওয়া চাড্ডি, আমি যে পিপিসি-কে চিনতাম, তিনি একজন সুন্দর মানুষ ছিলেন), সুজয় ঘোষ, রাজীব মাল, ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত, বাকিদের নাম মনে নেই।

সেই এক বছর আমাকে শিখিয়েছিল অনেক কিছু। যা তার আগের চার বছর শেখাতে পারে নি।

কেমিস্ট্রি অনার্স পড়ার পরে বেলঘরিয়াতে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেওয়া সেই মেয়েটি এখন আমার স্ত্রী। অবসর সময়ে আমরা আমাদের সেই ইলেভেন টুয়েলভের কোচিংয়ের দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করি। এখনও।


5 thoughts on “জলু – দশম (শেষ) পর্ব

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.