১৯শে জানুয়ারি, ১৯৯০ঃ ঠিক কী হয়েছিল?

কাশ্মীর ফাইলস নামে একটি সিনেমা নিয়ে আপাতত ভারতে তরজা তুঙ্গে। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক থেকে, তৎকালীন কাশ্মীর উপত্যকা থেকে কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে হুমকি, যার পরিণতি হিসেবে পণ্ডিতদের এক্সোডাস বা গণ-নিষ্ক্রমণ, একটি লজ্জাজনক অধ্যায়। মুসলিম-প্রধান এই ভূখণ্ডে পণ্ডিতরা যেহেতু হিন্দুধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তাঁদের নিয়ে গত কয়েক দশকে রাজনীতিও কম হয় নি, যার এক অন্যতম ফসল হল এই কাশ্মীরি ফাইলস সিনেমাটি। 

শুদ্ধব্রত সেনগুপ্ত লিখেছেন সেই বিশেষ রাতে, ১৯শে জানুয়ারি ১৯৯০ সালে, ঠিক কী ঘটেছিল, কীভাবে এই এক্সোডাস শুরু হয়েছিল, এবং কারা ছিল এই পুরো ঘটনাবলীর পেছনে। সিনেমাটি নিয়ে এই প্রবন্ধে কোনও আলোচনা নেই। এখানে শুধু তথ্য আছে, যে তথ্য সচরাচর সামনে আসে না। তাঁর মূল ইংরেজি লেখাটি থেকে আমি বাংলায় অনুবাদ করলাম, অনুমতিসহ। 


সোশ্যাল মিডিয়ায় বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রীর ছবি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-কে ঘিরে আলোচনার তীব্রতা, আগ্রহের সঙ্গে পড়ছি এবং নোট নিচ্ছি। আমি এখানে সিনেমাটি নিয়ে কোনও মন্তব্য করছি না, বরং তার সারবস্তুটির সম্পর্কে লিখতে চলেছি যাকে ঘিরে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া, ভাষ্য এবং সিনেমাটি নিয়ে আলোচনায় ঝড় তুলছে। এবং এই সারবস্তু হল ১৯৯০ সালের ১৯ শে জানুয়ারী শ্রীনগরের ঘটনা এবং কাশ্মীর থেকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ‘নির্বাসন’ করার ক্ষেত্রে সেগুলি কতটা বা কী কী অবদান রেখেছিল, তার সাথে সম্পর্কিত।
এই আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোটিফগুলির মধ্যে একটি হল, কাশ্মীরি পণ্ডিতরা স্বেচ্ছায় কতটা কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা। একদিকে ভারত অধিকৃত কাশ্মীর উপত্যকার অংশে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের কারণে তারা যে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছিল, এবং সেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করানোর পেছনে জম্মু ও কাশ্মীরের তৎকালীন নবনিযুক্ত গভর্নর জগমোহন মালহোত্রার ভূমিকা, এবং কিছুটা হলেও, তার ফল হিসেবে ‘নির্বাসন’ বা এক্সোডাসের ফন্দী তৈরি করা। যেসব জায়গা থেকে আমি তথ্য সংগ্রহ করেছি, সেগুলো সমস্তই পাবলিক ডোমেনে পাওয়া যায়, যদিও চিনে নিয়ে খুঁজে বের করা সহজ নয়। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য, এই উৎসগুলি থেকে তথ্য একত্রিত করে, কীভাবে এই ‘এক্সোডাস’ বা ‘নির্বাসন’ ঘটানো হয়েছিল, তার উপর আলোকপাত করা। আমি আশা করি এই লেখাটি, খুব বড় হওয়া সত্ত্বেও, চারপাশের ধোঁয়াশা কিছুটা হলেও পরিষ্কার করতে পারে।
এই অবধি যদি পড়ে ফেলেন, আর এর পরেও যদি পড়ার ইচ্ছে থাকে, তাহলে সময় নিয়ে বসুন। লেখাটা বেশ লম্বা।
—————————————————————————————-
১৯৯০-৯১ সালে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দেশত্যাগের জন্য জগমোহনকে দায়ী করা যেতে পারে কিনা, তাই নিয়ে আমার আপাতত বিশেষ মাথাব্যথা নেই। আমার মতে যে প্রশ্নটি করা উচিত তা হল, কাশ্মীরে দখলদারিত্বের জন্য ভারত রাষ্ট্র এবং তার যাবতীয় নিয়মনীতিকে দায়ী করা যায় কিনা। জগমোহন যেমন কিছু সময়ের জন্য দখলদারিত্বের রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হওয়ার দায় এড়াতে পারেন না, ঠিক তেমনি পণ্ডিত এক্সোডাসের জন্য তিনিই একমাত্র বলির পাঁঠা হতে পারেন না।
জগমোহন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের এক্সোডাসে কোনও ভূমিকা পালন করেছিলেন কিনা তা নিয়ে বিভ্রান্তি আংশিকভাবে রয়ে গেছে এই কারণে, যে ১৯৯০ সালের ১৯শে জানুয়ারি দিনটি তাঁর সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত। এই দিনটিতেই জগমোহন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন (দ্বিতীয়বারের জন্য)। তিনি তাঁর বই ‘মাই ফ্রোজেন টার্বুলেন্স ইন কাশ্মীর’-এ লিখেছেন, বনিহাল পাস নিয়ে ‘অশান্তি’র অর্থ হল, জম্মু থেকে কাশ্মীর যাওয়ার জন্য তিনি যে হেলিকপ্টারটি ব্যবহার করছিলেন, সেটিকে সেদিন জম্মুতে ফিরে যেতে হয়েছিল। সুতরাং, এটা মনে রাখা জরুরি, তিনি ১৯৯০ সালের ১৯শে জানুয়ারি শ্রীনগরে ছিলেন না।
ঘটনাবহুল রাত ছিল সেটি। শ্রীনগর শহরের ছোটা-বাজার গুরু-বাজার এলাকায় সেই শীতের সবচেয়ে খারাপ এবং সবচেয়ে ক্ষতিকর ‘কর্ডন অ্যান্ড সার্চ’ অভিযান পরিচালনা করা হয়। আটক করা হয় ৩০০ তরুণকে। মাসুদ হুসেন নামে একজন সাংবাদিক মনে করিয়ে দেন যে, অভিযানের সময় নির্বিচারে হিংসার প্রকাশ ঘটেছিল, সিআরপিএফ-এর লোকেরা পরিকল্পিতভাবে লোকেদের বাড়িতে রান্নাঘরে প্রবেশ করেছিল, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দোকানঘর বা গুদামে হানা দিয়েছিল এবং শীতকালের জন্য তাদের মজুত করে রাখা চালের মধ্যে বালি মিশিয়ে দিয়েছিল, আর চিনির পাত্রগুলিতে ঢেলে দিয়েছিল লঙ্কাগুঁড়ো।
কাশ্মীরের পরিস্থিতি তখন অগ্নিগর্ভ ছিল। জগমোহন নিজেই তাঁর বইয়ে বলেছেন- “ডঃ রুবাইয়া সাইদের অপহরণের দিন (৮ ডিসেম্বর, ১৯৮৯) যখন সন্ত্রাসের সন্ত্রাসের পুরো রাজত্ব চলছিল পুরো রাজ্য জুড়ে, তার আগের দিন পর্যন্ত, ১১ মাসে ৩৫২টি বোমা বিস্ফোরণ সহ ১,৬০০ টি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল। এরপর ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ জানুয়ারির মধ্যে ৩১৯টি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে – ২১টি সশস্ত্র হামলা, ১১৪টি বোমা বিস্ফোরণ, ১১২টি অগ্নিসংযোগ এবং ৭২টি গণহিংসার ঘটনা।” এই সব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের বেশিরভাগই ছিল কাশ্মীরি মুসলমান, (স্থানীয় রাজনীতিবিদ, ক্ষুদ্র প্রশাসক, সরকারী কর্মকর্তা, এনসি এবং কংগ্রেস কর্মী, কিছু পরিচিত ব্যক্তিত্ব এবং পুলিশের লোকেরা), কাশ্মীরি পণ্ডিতরা নয়।
যে কজন কাশ্মীরি পণ্ডিত এই হিংসার শিকার হয়েছিলেন, আমার জ্ঞান অনুযায়ী, তাঁদের সংখ্যা ছিল চার। টি এন টিপলু, বিজেপি-আরএসএস নেতা, শ্রীনগর দূরদর্শনের অধিকর্তা লাসসা কৌল, শীলা টিক্কু এবং জাস্টিস নীলকন্ঠ গঞ্জু (ইনি মকবুল বাটকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন)। এঁদের ওপর আক্রমণ হয়েছিল এঁদের রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য, এঁদের কাশ্মীরি পণ্ডিত হবার জন্য নয়। তিন-চারজনের মৃত্যু একটা গণ-এক্সোডাসের কারণ হতে পারে না।
এই সময় থেকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ওপর হিংসাত্মক ঘটনা একটি ভয়ানক প্যাটার্ন নিতে শুরু করে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, দরিদ্র ও অসুরক্ষিত পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে, মৌলবাদী বা জাতীয়তাবাদী এজেন্ডায় আসক্ত ‘জঙ্গিদের’ নেতৃত্বে। কিন্তু এসব ঘটনা ১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারির আগে ঘটে নি, এবং প্রকৃতপক্ষে, প্রধানত যাঁরা বিশেষভাবে দুর্বল ছিলেন, তাঁদের গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া হওয়ার পরে সামগ্রিকভাবে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের এক্সোডাস গতি পেয়েছিল। একইভাবে, বেশ কিছু কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারকে এই সময়ে যে ভয়ানক হিংসার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তার দায়ভার সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও অ-রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট এক ধরণের ঘৃণ্য ইসলামী মতাদর্শের ওপর বর্তায়। পাকিস্তানের মদতে সন্ত্রাসবাদ একদিকে ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে ভারত শাসিত কাশ্মীরের ঘোলা জলে মাছ ধরতে আগ্রহী ছিল, অন্যদিকে কাশ্মীর উপত্যকায় পণ্ডিতদের, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, প্রতিরক্ষাহীন এবং বিচ্ছিন্ন রেখে যাওয়ার ভারতীয় রাষ্ট্রের একটি ইচ্ছাকৃত নীতি, দুই মিলিয়ে তাঁদের বাধ্য করেছিল দলে দলে কাশ্মীর ছেড়ে চলে যেতে। যাকে আমরা বলি এক্সোডাস।
কিন্তু সে-সব কথা পরে। আমরা ফিরে আসি ১৯শে জানুয়ারি, ১৯৯০ সালের সেই রাতে।
সেই রাতে টিভিতে রোমানিয়ার বিপ্লব দেখানো হচ্ছিল। মাত্র এক মাস আগে বার্লিনের পাঁচিল ভেঙে পড়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে কিছুদিন আগে, সেই সংক্রান্ত অশান্তি, বিশেষত আজারবাইজানের গণ্ডগোল সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল দূরদর্শনে। (জগমোহন মনে করতেন, এমনিতে প্রায়-অচল দূরদর্শনের পক্ষে সেই রাতে এইসব বিপ্লবের ভিডিও ব্রডকাস্ট করা একেবারে উচিত হয় নি – শ্রীনগরের লোকের হয় তো মনে হয়েছিল দুনিয়া বদলে যাচ্ছে, তাদের দুনিয়াও এইভাবেই বদলে যাবে।)
বহু লোকের স্মৃতিতে রয়ে গেছে সেই সন্ধ্যা, সারা রাত জুড়ে মসজিদের লাউডস্পিকার থেকে শ্লোগান দেওয়া হচ্ছিল, রাস্তায় মানুষজন শ্লোগান দিচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে একটি শ্লোগান ছিল – “জাগো জাগো সুবহ হুয়ি; রুশ নে বাজি হারি হ্যায়, হিন্দ পর লারজান তারে হ্যায়, অব কাশ্মীর কি বারি হ্যায়”।
স্পষ্টতই, একটি বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শ্লোগান, যা পণ্ডিতদের ভ্যালি থেকে চলে যেতে বলছে, তাদের বাড়ির মহিলাদের ফেলে রেখে, বিভিন্ন জায়গায় শোনা গিয়েছিল। ২১ শে জুন, ২০১৮ তারিখে Raiot-এ প্রকাশিত অঙ্কুর দত্তের অভিবাসী/উদ্বাস্তু কাশ্মীরি পণ্ডিতদের অভিজ্ঞতা এবং জম্মুর স্মৃতির নৃতাত্ত্বিক আলোচনার (অন আনসার্টন গ্রাউন্ড: আ স্টাডি অফ ডিসপ্লেসড কাশ্মীরি পণ্ডিতস ইন জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস-ইন্ডিয়া, ২০১৬) ওপর সঞ্জয় কাক-এর রিভিউ, ‘হোয়াট অ্যাবাউট কাশ্মীরি পণ্ডিতস’-এ এই শ্লোগানটির একটি আকর্ষণীয় আলোচনা রয়েছে। এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
একটি বিশেষভাবে যৌনগন্ধী হুমকি প্রায় সব সমসাময়িক পণ্ডিত আখ্যানের মধ্যে হুবহু উদ্ধৃত হয়, অঙ্কুর দত্ত লিখেছেন, এবং আমরা জানি যে এটি ১৯৯০এর প্রথম দিকের মাসগুলির স্মৃতিতে কেন্দ্রীভূত। “বাতাভ বাগেয়ার, বাতনেভ সান” – একটি অবরুদ্ধ সংখ্যালঘুদের জন্য এই সবচেয়ে ক্ষতিকারক শ্লোগানগুলি প্রস্তাব করে যে জনতা কাশ্মীরের জন্য আজাদি চায়, ‘পণ্ডিত পুরুষদের ছাড়াই, তাদের মহিলাদের সাথে’। সংবাদপত্রের আর্কাইভের দিকে তাকালে অঙ্কুর দেখতে পান যে এই ঘৃণ্য শ্লোগানের প্রথম দিকের প্রতিবেদনগুলি প্রায় কয়েক বছর পরে উদ্ধৃত হচ্ছে: “পণ্ডিতরা যে শ্লোগানগুলি শুনেছিলেন তা সেই সময় আনুষ্ঠানিকভাবে কখনও রিপোর্ট করা হয়নি এবং যা রেকর্ড করা হয়েছিল এবং পণ্ডিতরা যা বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে বিস্তর ফাঁক রয়েছে”। এই সময়ের সংবাদপত্রগুলি অবশ্যই ‘মব ভায়োলেন্স’, পুলিশি পদক্ষেপের কারণে হতাহতের পাশাপাশি বড় আকারের গ্রেপ্তারের দিকে মনোনিবেশ করে।
অঙ্কুর দত্তের বইয়ে যা সামান্য বিবরণ বলে মনে হতে পারে তার প্রতি আমি এখানে যে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি, তার অর্থ এই নয় যে নির্দিষ্ট শ্লোগানটি কখনোই উত্থাপিত হয়নি। তবে এটি সম্ভবত ততটা ব্যাপক ছিল না যতটা ব্যাপক বলে পরে দাবি করা হয়েছিল। এবং এই কুৎসিত শ্লোগানটি গত কয়েক দশক ধরে অভিবাসীদের স্মৃতিতে বয়ে চলেছে, যা সামগ্রিকভাবে তাদের এক্সোডাসের গল্পের অংশ হিসেবে রয়ে গেছে, এবং অঙ্কুর দত্ত অন্য কোথাও পণ্ডিতদের ক্ষয়ক্ষতির একটি “একক আনুষ্ঠানিক বিবরণ” উল্লেখ করেছেন যেখানে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
সুতরাং, কাশ্মীরি পণ্ডিত মহিলাদের ‘থেকে যেতে’ বলা হচ্ছে বলে এই শ্লোগানটি সম্পর্কে এখন প্রায় সম্পূর্ণরূপে পৌরাণিক কাহিনী তৈরি হয়ে গেছে বলার পরেও, এটা বলা মোটেও অযৌক্তিক নয় যে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক শ্লোগানের ভয়াবহতায় উদ্বিগ্ন এবং ভীত ছিলেন। এবং তার যথেষ্ট কারণ ছিল।
কিন্তু তখনও অবধি খুব বেশি লোক নিহত বা আহত হননি। ভারতে আজকাল যে ধরনের শ্লোগান নিয়মিত ভাবে শোনা যায়, তাতে মনে হবে, কিছু কাশ্মীরি পণ্ডিত সংগঠন যে দিনটিকে ‘কাশ্মীরি পণ্ডিত হলোকাস্ট ডে’ হিসেবে পালন করে, সেই হিসেবে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে বিপুল সংখ্যক মানুষ দৈনিক তাদের ‘হলোকস্ট ডে’ পালন করতে পারে। তবে আপাতত আমরা এসব তুলনা একপাশে রেখে দিই।
পরের দিন মানুষ মারা যায়। আধাসামরিক বাহিনী গুলি চালালে শ্রীনগরের গাওকাদালে ৫২ জন কাশ্মীরি মুসলিমের মৃত্যু হয়। জগমোহন তখন শহরে ছিলেন, এবং তাঁর অধীনে থাকা বাহিনীর ক্রিয়াকলাপের দায় তিনি এড়াতে পারেন না। তার পরের দিন আরও বেশি লোককে হত্যা করা হয়, এবং এর পরে ভিড়ের মধ্যে গুলি করে মারার আদেশ দেওয়া একটা প্যাটার্নে পরিণত হয়েছিল, যা কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণ করে চলেছিল।
১৯ জানুয়ারি রাতে পালাতে চাওয়া কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়ে কোনও বাস বা ট্রাক কাশ্মীর ছেড়ে যায়নি। কেউ কেউ হয়তো চলে গেছেন, কিন্তু ‘সামগ্রিক’ এক্সোডাস, ১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারি ঘটেনি।
ঘটতে শুরু করে, একটু পরে। জানুয়ারীর ২০ থেকে ২৪ তারিখের মধ্যে, এবং মার্চের মাঝামাঝি সময়ে, এবং আরও, পরবর্তী দিনগুলিতেও আরও এক্সোডাসের খবর পাওয়া গেছে। ১৯৯১ সালের শেষের দিকে, প্রায় ৩০০,০০০ পণ্ডিত উপত্যকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কোনও দিন হয় তো কোনও অধ্যবসায়ী আর্কাইভ করা তদন্ত আদেশগুলির (ফর্মাল এবং ইনফর্মাল) কিছু বিবরণ আবিষ্কার করতে সক্ষম হতে পারে যা দিল্লি এবং শ্রীনগরের ডেস্কগুলির মধ্যে চালাচালি হয়েছিল সেই সময়ে। কিন্তু আপাতত, যাদের সরানোর জন্য সেসব আদেশ তৈরি করা হয়েছিল, তাদের সাক্ষ্যের উপর আমাদের নির্ভর করতে হবে।
আর তাই, আমি সম্পূর্ণভাবে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করছি, যারা জগমোহনের উপর দোষ চাপিয়েছেন। হ্যাঁ, আমি একজন মূলধারার কাশ্মীরি মুসলিম রাজনীতিবিদ সাইফুদ্দিন সোজের স্মৃতিকথার উপর নির্ভর করি, যিনি এখন কংগ্রেস পার্টিতে, কিন্তু তিনি যে সূত্রগুলি উদ্ধৃত করেছেন তা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দেওয়া – এবং এই কণ্ঠস্বরগুলিই আমি এখানে শুনতে আগ্রহী। আমি কাশ্মীরি মুসলমানদের বা ভারতের ‘মানবাধিকার’ওয়ালাদের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করছি না।
এখানে কয়েকটি জায়গা থেকে কিছু তথ্যের উল্লেখ করছি, যেখানে তাঁরা কী বলতে চেয়েছিলেন, সে সম্পর্কে আমরা কিছু ধারণা পেতে পারি।
————————
১। কাশ্মীর সেন্টিনেল
প্রথমটি হল কাশ্মীর সেন্টিনেলের উপর একটি পোস্ট, প্রাথমিকভাবে একটি কাশ্মীরি পণ্ডিত প্রকাশনা, পানুন কাশ্মীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিল (মনে হচ্ছে এটি এখন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে) যা নাগরোটা শিবিরের কেএল কৌলকে উদ্ধৃত করছে, যিনি সরাসরি দেশত্যাগের জন্য জগমোহনকে দোষারোপ করার কথা বলেন। এখানে যাত্রা শুরুর তারিখগুলি ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯ নয়, বরং ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। কেএল কৌল ২০০৩ সালে কাশ্মীরভিত্তিক একটি সংবাদপত্রে এ বিষয়ে লিখেছিলেন, যা ১১ জন কাশ্মীরি পণ্ডিত উদ্বাস্তুর একটি দল দ্বারা সমর্থিত হয়, যারা ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে একই সংবাদপত্রে পরে লেখেন। তারা যা লিখছেন তা লক্ষ্য করার মত।
কাশ্মীর সেন্টিনেল, জানুয়ারি ২০০৩
এটি অ্যাক্সেস করা হয়েছে ২৬শে জুন ২০১৯ ০০:৩৬:১৯এ cache থেকে
“একদিকে কয়েকজন পন্ডিত উদ্বাস্তু এবং অন্যদিকে শ্রীনগরের দৈনিক আল-সাফা নিউজের কলামগুলিতে কাশ্মীরি মুসলমানদের (একটি জঙ্গি সংগঠনের প্রতিনিধি সহ) মধ্যে একটি আকর্ষণীয় কথোপকথন, পরিবর্তিত মেজাজের ইঙ্গিত দেয় এবং প্রাক্তন গভর্নর জগমোহনের চক্রান্তও প্রকাশ করে, যিনি এই বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ‘গণ অভিবাসন’ সংগঠিত করেছিলেন।
জম্মুর নাগরোটা ট্রানজিট ক্যাম্পে বসবাসকারী জনৈক কেএল কৌল এই পত্রিকায় (১৮ই সেপ্টেম্বর) একটি চিঠিতে লিখেছিলেন যে জগমোহন ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে উপত্যকার পণ্ডিতদের কাছে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় সরে যাবার অনুরোধ জানিয়ে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন, কারণ সরকার এই অভ্যুত্থানকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে প্রায় ১,৫০,০০০ কাশ্মীরি মুসলমানকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। চিঠিতে বলা হয়েছে, “পন্ডিতদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল” যে, “কাশ্মীরি মুসলমানদের গণহত্যা শেষ হয়ে গেলে এবং আন্দোলন দমন করা হয়ে গেলেই তাদের উপত্যকায় আবার ফেরত আনা হবে। এ কারণে পণ্ডিতদের অধিকাংশই তাদের জিনিসপত্র বাড়িতেই ফেলে রেখে চলে যায়”। তবে জম্মুতে আসা উদ্বাস্তু পণ্ডিতদের জন্য এই ‘সরে যাওয়া’র অভিজ্ঞতা খুব সুখের ছিল না। স্থানীয় জনগণের সহানুভূতির প্রাথমিক প্রকাশের পরে, এখন “আমাদের সম্প্রদায়কে অবজ্ঞা করা হয় এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পরজীবী ছাড়া আর কিছুই হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। আমাদের যুবকরা ভবঘুরে হয়ে গেছে কারণ তাদের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার নেই। কিছু যুবক মাদক সেবন করেছে…” চিঠির লেখক তখন জঙ্গি ও কাশ্মীরি মুসলমানদের প্রতি “বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আমার সম্প্রদায়কে ক্ষমা করার” আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমরা বাড়ি ফিরে যেতে প্রস্তুত এবং আমরা কেবল আপনার কাছ থেকে একটি কলের জন্য অপেক্ষা করছি…”
এই চিঠির উত্তরে কাশ্মীরি মুসলমানদের কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইঙ্গিতবাহী, যা আজও এই উপত্যকায় টিকে আছে। একটি চিঠি বাদ দিয়ে – যার লেখক পণ্ডিতদের ফিরে আসার বিরোধিতা করেছেন – পত্রিকায় প্রকাশিত বাকি প্রায় সমস্ত চিঠিগুলি পণ্ডিতদের ভুল সংশোধন করার এবং ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষাকে প্রশংসা করে। তারা তাদের পূর্বতন পণ্ডিত প্রতিবেশিদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে তাদের বাড়িঘর এবং জিনিসপত্র এখনও অক্ষত রয়েছে এবং ভালভাবে যত্ন নেওয়া হয়েছে, জম্মুর শরণার্থী শিবিরে তাদের দুর্দশার জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করে, বিজেপি এবং হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির নির্দেশে তাদের মুসলিম ভাইদের পরিত্যাগ করার জন্য হাল্কা করে তাদের তিরস্কার করে এবং তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর নৃশংসতার নিন্দা করতে বলে। বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হল একটি জঙ্গি সংগঠনের বেশ কয়েকজন পদাধিকারীর স্বাক্ষরিত একটি চিঠি, যারা পণ্ডিতদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে জঙ্গিরা এর আগে পণ্ডিতদের “জাতির (জম্মু ও কাশ্মীরের) ভাই বেরাদর এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ (পার্ট অ্যান্ড পার্সেল)” হিসাবে ঘোষণা করেছিল। তারা আরও যোগ করে যে, যেহেতু পন্ডিত অভিবাসীরা এখন বুঝতে পারছেন যে বিজেপি এবং শিবসেনা ‘বিশ্বাসঘাতক’, তাই তাঁরা যেন “প্রথমে তাদের পাথর মেরে হত্যা করেন এবং তারপরে উপত্যকায় ফিরে যাওয়ার কথা ভাবেন …”
ইতিমধ্যে, একই সংবাদপত্রে (২২ সেপ্টেম্বর) একটি চিঠিতে জম্মুতে বসবাসকারী ২৩ জন কাশ্মীরি পণ্ডিত উদ্বাস্তু আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এই বলে, যে এই বছরের শুরুতে জগমোহনের দেওয়া উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ার আদেশ না মানলে কর্তৃপক্ষ তাদের “মারাত্মক পরিণতি”র হুমকি দিয়েছে। তাঁরা স্বীকার করেন যে ‘জেনে বা না-জেনে সাময়িক পরিস্থিতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে আমাদের ভূমিকায় একটি বড় ভুল হয়েছে’, তাঁরা ‘ভারতীয় দখলদার বাহিনী আমাদের ভাইদের ওপর যে নিপীড়ন চালাচ্ছে’ তার নিন্দা জানান এবং শেষে বলেনঃ “জম্মু ও কাশ্মীরের মত একটি স্বাধীন, স্বশাসিত ও সমৃদ্ধ দেশে বসবাসের আমাদের স্বপ্ন খুব শীঘ্রই পূরণ হোক”।
কাশ্মীরি পন্ডিত এবং মুসলমানরা তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মৌলবাদী নেতাদের যারা তাদের আলাদা রাখার চেষ্টা করছে, তাদের অজ্ঞাতসারেই একটি মানবিক কথোপকথন শুরু করেছে, এসব দেখে খুব ভাল লাগে।বেশ প্রত্যাশিতভাবেই, জাতীয় সংবাদ মাধ্যম (যারা এখনও কাশ্মীর সমস্যাকে সাম্প্রদায়িক বানাবার খেলা খেলছে) এই গুরুত্বপূর্ণ সংলাপকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গিয়েছে। যেহেতু জম্মু ও কাশ্মীরের বাইরের লোকদের সেখানে উন্নয়ন সম্পর্কে তথ্যের বিকল্প উৎসগুলিতে কোনও অ্যাক্সেস নেই (যেমন উপরে বর্ণিত পন্ডিত উদ্বাস্তুদের পরিবর্তিত আবহ), তাই দিল্লি-ভিত্তিক নাগরিক স্বাধিকারের গ্রুপ – কমিটি ফর ইনিশিয়েটিভ অন কাশ্মীর – কাশ্মীর ডসিয়ার নামে একটি সংবাদ বুলেটিন প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বিভিন্ন জায়গা থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করে। আশা করা যায় যে, পাঠকদের কাশ্মীরের ঘটনাবলীর একটি বিস্তৃত চিত্র প্রদানের এই প্রচেষ্টা আমাদের সকল শ্রেণীর জনগণের মধ্যে একটি বার্তালাপ শুরু করতে পারে এবং কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের দিকে একটি ঐকমত্যের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
২। সইফুদ্দিন সোজ.
এর বেশিরভাগই প্রবীণ কাশ্মীরি মূলধারার রাজনীতিবিদ সাইফুদ্দিন সোজের স্মৃতিকথা – রূপা পাবলিকেশনসের “কাশ্মীর: গ্লিম্পসেস অফ হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য স্টোরি অফ স্ট্রাগল”-এ প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ইনি সাংবাদিক, প্রশাসক, কাশ্মীরি পণ্ডিত অ্যাক্টিভিস্ট এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
প্রাসঙ্গিক অংশগুলি এইখানে খুঁজে পাওয়া যাবেhttp://forceindia.net/books/a-history-of-bitterness/
কিন্তু আমরা তার কিছু অংশ এখানেই তুলে দিচ্ছি।
“শবনম কায়ুম কেন এবং কীভাবে জগমোহনের নির্দেশে পণ্ডিতদের দেশত্যাগ হয়েছিল তা নিয়ে ব্যাপকভাবে লিখেছেন। কায়ুম পণ্ডিত সম্প্রদায়ের নেতাদের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি চিঠি পেয়েছিলেন, যাঁরা এই যাত্রাকে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন এবং এর জন্য জগমোহনকে দায়ী করেছিলেন। আল-সাফা, রোশনি এবং শ্রীনগর টাইমসের মতো সংবাদপত্রে এমন অনেক চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। এমনই একটি চিঠি জম্মুর নাগরোটা ক্যাম্প থেকে লিখেছেন কেএল কৌল। অনেক পণ্ডিত রোশনি পত্রিকার সম্পাদককে এগারো জন পণ্ডিত নেতার স্বাক্ষরিত একটি যৌথ চিঠি লিখেছিলেন, যাঁরা এই এক্সোডাসের জন্য জগমোহনকে দায়ী করে এটিকে একটি পরিকল্পিত ঘটনা হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। পণ্ডিতদের কাছ থেকে আমি এই জাতীয় চিঠিও পেয়েছিলাম।
অনেক বিশিষ্ট পণ্ডিত নেতা আমাকে সরাসরি চিঠি লিখেছিলেন এবং পণ্ডিতদের দেশত্যাগকে একটি দুঃখজনক পরিস্থিতি হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন এবং তাঁরা পানুন কাশ্মীরের প্রতি আমার বিরোধিতাকে সমর্থন করেছিলেন, যেটি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জন্য একটি পৃথক মাতৃভূমি দাবি জানিয়েছিল।
শ্রীনগরের সাফা কাদালে ওমকার নাথ পাজনুর সাথে আমার দেখা হয়েছিল, যেখানে তিনি সাধক ও কবি রূপা ভবানীর (১৬২০) জন্মস্থান দেখাশোনা করেন, যিনি একটি পণ্ডিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে অনেক মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। শ্রীনগরের কেন্দ্রস্থলের দুর্বলতম অংশ হিসাবে পরিচিত এই এলাকায় পাজনু এত বছর ধরে বাস করেছেন। তিনি বলছিলেন যে কঠিন সময় চলছিল, তা সত্ত্বেও তিনি আশপাশের মন্দিরে যেতে থাকেন এবং পরে সেখান থেকে রূপা ভবানী মন্দিরে যান। তিনি আরও জানান যে তিনি কখনোই কোনও হুমকির সম্মুখীন হননি, যদিও এলাকাটি (খানকাহি সোখতা-সাফা-কাদাল) প্রধানত একটি মুসলিম মহল্লা, পাজনু বিশ্বাস করেন যে অন্য অনেকের মতো পণ্ডিতদের প্রস্থান একটি সংঘটিত পর্ব ছিল, তবে তিনি বলতে চান না কার নির্দেশে এই এক্সোডাস ঘটেছিল।
এরপর, আমি সঞ্জয় টিকুর সাথে দেখা করি, যিনি একজন অ-অভিবাসী পণ্ডিত নেতা। ১৯৯০ সালের জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে জগমোহনের সাথে দেখা করা পণ্ডিত নেতাদের একটি প্রতিনিধি দলের মধ্যে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে তাঁর প্রাথমিক অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি বলেন, জগমোহন জোর দিয়েছিলেন যে তিনি পণ্ডিতদের বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তা দিতে পারবেন না এবং তাই, তাদের কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে হবে যেখানে তাদের নিরাপত্তা প্রদান করা যেতে পারে এবং সরকার একটি নিরাপদ জায়গা বেছে নেবে।
এই প্রস্তাবকে ঘিরেই সব আলোচনা হয়েছে। টিকুর মতে, প্রতিনিধিদল যখন রাজভবন থেকে তাদের সদস্যদের নিয়ে বের হয়, তখন হীরা লাল চাট্টা এবং হরিদয় নাথ জাট্টু বুঝতে পারেন যে জগমোহন তাঁদের নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করেছেন এবং পণ্ডিতদের অবিলম্বে কাশ্মীর ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন।
টিকু মনে করতেন যে জাট্টু এবং চাত্তা জগমোহনের মনোভাবকে অতিরঞ্জিত করেছেন। তাঁরা প্রতিটি পণ্ডিত পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন এবং তাদের চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তবে টিকু নিশ্চিত করেছেন, সন্দেহাতীতভাবে সেদিন জগমোহনকে নার্ভাস এবং অত্যন্ত ভীত দেখাচ্ছিল এবং তিনি দেখা করতে আসা পণ্ডিত প্রতিনিধি দলের সদস্যদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারেননি। জাট্টু এবং চাট্টা যে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করেছিলেন তা পণ্ডিতদের আরও ভয় দেখাচ্ছিল এবং এর পরে এক্সোডাসের ঘটনা ঘটেছিল। তিনি আরও বলেন, কিছু পরিবার জানিয়েছিলেন যে একটি নির্দিষ্ট রাতে তাঁদের জন্য ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তবে কে ব্যবস্থা করেছিল, টিকুর কাছে সে সম্পর্কে কোনও তথ্য ছিল না। তিনি বলেন, ১৯৯০ সালের ২০-২১ জানুয়ারির দিকে এই এক্সোডাস শুরু হয় এবং ১৯৯০ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আরো কিছু এক্সোডাসের ঘটনা ঘটে।
খেম লতা ওয়াখলু, একজন প্রাক্তন মন্ত্রী এবং একজন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা, যিনি জঙ্গিদের হাতে তাদের ৪৫ দিনের বন্দীদশায় স্বামীর সাথে অনেক অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, পরে একটি বইয়ে এই যন্ত্রণার কথা বর্ণনা করেছিলেন। তিনি সম্প্রতি আমাকে বলেছিলেন যে ১৯৯০ সালে, এক সন্ধ্যায় গাগরিবাল (শ্রীনগর)-এ এক পুলিশ সদস্য তাঁদের দরজায় কড়া নাড়েন, জানতে চান যে তাঁরা কাশ্মীর ছেড়ে চলে যেতে চান কিনা। তিনি আরও যোগ করেন যে তাঁদের ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু যদি তাঁরা এখানেই থেকে যেতে চান তবে তা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত হবে। তিনি এবং তার পরিবার থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কে বা কারা ওই পুলিশ সদস্যকে তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়েছিল, সে বিষয়ে তাঁদের কোনো ধারণাই ছিল না।
দিন নাথ রায়না তাঁর ‘কাশ্মীর: ডিসটর্সনস অ্যান্ড রিয়েলিটি’ বইয়ে এই এক্সোডাসেরর বর্ণনা দিয়েছেন। জঙ্গিদের হাতে পণ্ডিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বেছে বেছে হত্যার ভয়ানক কালপঞ্জির হিসাব দিয়েছেন, যা স্পষ্টতই উপত্যকার এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করেছিল। তবে এই সত্যটি রয়ে গেছে যে এই এক্সোডাস একটি সংগঠিত ঘটনা ছিল এবং সরকারের মধ্যেই কেউ এটি কার্যকর করার জন্য একটি সার্বিক প্রচেষ্টা করেছিল।
পরিকল্পিতভাবে কিছু নির্দিষ্ট এলাকার পণ্ডিতদের জন্য ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং তাঁদের উপত্যকা ছেড়ে চলে যাবার প্রক্রিয়ায় পুলিশ বিভাগ সম্পূর্ণভাবে যুক্ত ছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
এমন অকাট্য প্রমাণ রয়েছে যে জগমোহন পণ্ডিতদের এক্সোডাস সংগঠিত করার জন্য পুরোপুরি দায়ী ছিলেন, যা জম্মু এবং অন্য কোথাও পণ্ডিতদের নিরাপদে পাঠিয়ে দেবার জন্য তাঁর প্রচেষ্টা হিসাবে কিছু লোক বর্ণনা করেছিল।
জগমোহনের কয়েকজন সহযোগী আমাকে এই সত্যটি জানিয়েছিল যে জগমোহনের মনে কাশ্মীরের পণ্ডিতদের দুর্ব্যবহারের বিষয়ে তার মনে একটি বড় অস্বস্তি ছিল এবং তিনি প্রায়শই আত্মবিশ্বাসের সাথে তাঁর মানসিক অবস্থাকে গুরু তেগ বাহাদুরের কাছ থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা হিসাবে বর্ণনা করতেন, যাঁকে তিনি মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করতেন।
১৯৯৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত জগমোহনের ‘কাশ্মীর ইন শিখ হিস্ট্রি’ প্রবন্ধটি থেকে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় যে তিনি কাশ্মীর নিয়ে গুরু তেগ বাহাদুরের উদ্বেগের চেতনা অনুসরণ করতেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, দুর্ভাগ্যবশত, কাশ্মীর সম্পর্কে জগমোহনের একটি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ ছিল এবং, এই অবস্থান তিনি বরাবর বজায় রেখেছেন।
১৯৯২ সালের ৬ আগস্ট টাইমস অব ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত ‘ব্রেকিং কাশ্মীর ইমপাস’ প্রবন্ধে প্রফুল বিদওয়াই বলেন, ‘১৯৯০ সালের জানুয়ারির সেই ভয়ানক টার্নিং পয়েন্টের পর কাশ্মীরিদের বেশিরভাগই ভারত থেকে গুরুতরভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জগমোহনের পরিচালনায় পণ্ডিতদের উপত্যকা ছেড়ে চলে যেতে উৎসাহিত করার নীতি এবং তাদের উপর মৌলবাদী আক্রমণ দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ককে রক্তাক্ত করে দেয়, যার ফল ছিল বেদনাদায়ক এক্সোডাস।’
জম্মুতে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া কাশ্মীরি পণ্ডিত নেতাদের কাছ থেকে আসা বেশ কয়েকটি চিঠির মধ্যে, নাগরোটা শিবির থেকে কেএল কৌলের লেখা একটি বিস্তারিত চিঠি শ্রীনগরের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে তিনি সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে, বিশেষ করে জগমোহনকে পণ্ডিতদের দেশত্যাগের জন্য দায়ী করেছিলেন, যা তিনি কাশ্মীরের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হিসাবেও বর্ণনা করেছিলেন।
কাশ্মীরের একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার ইসরার খান, যিনি খুব সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন, তিনি প্রমাণ দিয়েছেন যে ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে পণ্ডিত প্রস্থান সংগঠিত করার জন্য রাজভবন কর্তৃক জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে চাপ দেওয়া হয়েছিল। কাশ্মীর লাইফ, শ্রীনগর থেকে প্রকাশিত পত্রিকা, ২২ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০১৭এর সংখ্যায় ইসরার খানের সাথে একটি ব্যাপক সাক্ষাৎকার ছাপিয়েছিল, যেখানে তিনি অন রেকর্ড বলেছিলেন যে ১৯৯০ সালের এপ্রিলে যখন তিনি সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার ছিলেন তখন শ্রীনগরের কোঠিবাগ পুলিশ স্টেশনের এসডিপিও (সেই দিনগুলিতে পুলিশি কার্যকলাপের কেন্দ্রস্থল) তাঁকে রাজভবনে তলব করেছিলেন, যেখানে জগমোহনের প্রধান সচিব এবং শ্রীনগরের এসএসপি আল্লাহ বক্শ খানকে পণ্ডিতদের জম্মুতে নিয়ে যাওয়া বাসগুলির নিরাপদ পরিবহন সুনিশ্চিত করতে আদেশ করেছিলেন। জগমোহন নিজেই তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘লোডিং শোডিং মে মদদ করনা অউর কোই অ্যাটাক শ্যাটাক নহি হোনে দেনা’ (জনগণকে তাদের জিনিসপত্র লোড করতে সাহায্য করুন এবং দেখুন যেন তাদের উপর কোনও আক্রমণ না হয়)।
————————
তো, কেএল কাউল, ওমকার নাথ পাজনু, সঞ্জয় টিকু, খেমলতা ওয়াখলু, দীন নাথ রায়না এবং ইসরার খান – সকলেই কি মিথ্যা বলছেন? যখন তাঁরা আলাদা আলাদা ভাবে একই কথা বলেছেন যে, জগমোহন নিশ্চিতভাবে ১৯৯০/৯১ সালে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কাশ্মীর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন?
বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রীর ছবি – ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ দেখবেন কিনা, সেটা আপনাদের ওপরেই ছেড়ে দিচ্ছি।
পরিশেষে, আরও একটি প্রশ্ন বিবেচনা করার আছে – এবং তা হল কাশ্মীরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে নীরবতা, উদাসীনতা বা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ওপর হওয়া নৃশংসতার বিষয়ে মুখ না খোলার অভিযোগ।
১৯৯০ সালের শুরুর দিকের ঘটনাবলীর আলোচনায় একটি বিশেষ বিষয় যা চোখে পড়ে, তা হল কাশ্মীরি মুসলিম জনগোষ্ঠী তাদের পণ্ডিত প্রতিবেশিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার প্রতিবাদে কোনও পদক্ষেপ নিয়েছিল কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যদিও বেশ কয়েকজন কাশ্মীরি পণ্ডিতের ব্যক্তিগত সাক্ষ্যে তাঁদের মুসলিম প্রতিবেশি ও পরিচিতদের সাহায্য বা সহানুভূতির কথা বলা হয়েছে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা কিছু কাশ্মীরি মুসলিম প্রতিবেশি এবং পরিচিতদের থেকে পাওয়া নিষ্ঠুরতা, বিদ্বেষ, বা সহানুভূতির অভাবের কথা বলে। সামগ্রিক সংহতির উদাহরণ সত্যিই বিরল। কিন্তু দুর্লভ মানে কি একেবারেই অনুপস্থিত? না, তা নয়। শ্রীনগরের গাওকাদল এলাকার নয়ি সড়কে সোহান লাল ব্রারু, তাঁর স্ত্রী বিমলা ও মেয়ে অর্চনাকে (যাদের দুজনকেই হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছিল) হত্যার অন্তত একটি ঘটনার কথা আমরা জানি। এটি ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে নয়, বরং ১৯৯২ সালের ৩১শে মার্চ ঘটেছিল। আমরা যা জানি তা হল স্থানীয় প্রায় পাঁচ হাজার মুসলমানের একটি শক্তিশালী বিক্ষোভ স্থানীয় কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর সহিংসতার এই পর্বের বিরুদ্ধে প্রদর্শনের মাধ্যমে রাস্তায় নেমে এসেছিল।
আমরা শুধু এটুকু মনে রাখি যে, এটি চরম বিশৃঙ্খলা ও দুর্দশার সময় ছিল, এবং পণ্ডিতদের মতই আরও অনেক কাশ্মীরি মুসলিম হিংসার শিকার হয়েছিল – রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনির হাতে, রাষ্ট্রের হাতে, এবং বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের হাতে। সুতরাং সাধারণ কাশ্মীরি মুসলমানদের ভাগ্যেও সেই সময়ে অনেক কিছু লেখা ছিল। তার পরেও, পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কাশ্মীরের মুসলমানদের সংগঠিত বিরোধিতার এমন আর কোনও উদাহরণ আছে কিনা, সেই পরিস্থিতিতে তা জিজ্ঞাসা করা কি অন্যায় নয়?
কতটা বিরোধ, কতটা প্রতিরোধ হয়েছিল, তা বলার মত যথেষ্ট তথ্য আমার কাছে নেই। কিন্তু এটা অনুমান করা কি অযৌক্তিক যে, কিছু হয়তো হয়েছিল? আমার তো এরকম মনে হয় না।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.