দেখতে দেখতে তিন বছর পেরিয়ে গেল, বিদেশবাসের। অনেকদিন থাকলে যেমন একটা শহরকে বদলাতে দেখা যায়, সেই রকমের বদলও দেখে ফেলছি আস্তে আস্তে। নতুন দেশ দেখার যে প্রাথমিক উত্তেজনা থাকে, ক্রমশ সেই উত্তেজনাও থিতিয়ে গেছে সময়ের সাথে সাথে।
এখন মানুষ দেখি। নানা রকমের মানুষ। আমার মতন মানুষ। নানা দেশ থেকে আসে। তাদের বলে এক্সপ্যাট। বিভিন্ন ইমেলে নিজের প্রাথমিক ইন্ট্রোডাকশন দিতে গিয়ে লিখি, আই অ্যাম অ্যান ইন্ডিয়ান এক্সপ্যাট লিভিং ইন …
আমি যে দোকানে কাজ করি, সেটা মূলত এক্সপ্যাটদের নিয়ে তৈরি কোম্পানি। ফাউন্ডার এবং সিইও যদিও একজন ডাচ, কিন্তু গোটা কোম্পানিতে ডাচ সহকর্মী খুব খুব কম পরিমাণে আছে। বরং আছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ দেশে এসে বাস করা মানুষজন। নেদারল্যান্ডস খুবই এক্সপ্যাট-ফ্রেন্ডলি দেশ, অনেক রকমের সুযোগ-সুবিধে পাওয়া যায় বিদেশি হিসেবে এখানে কাজ খুঁজে পেলে।
সেই বিভিন্ন দেশের মানুষজন যখন একসাথে একটা দোকানে কাজ করে, ছোট্ট দোকান, সেখানে কোনও স্থানীয় সংস্কৃতি আর বড় হয়ে দেখা যায় না। ফলে, আমাদের দোকানটি আমস্টারডামে রেজিস্টার্ড হলেও, এখানে কোনও ডমিনেন্ট ডাচ কালচার নেই। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের, নানা দেশের সংস্কৃতির একটি অদ্ভুত সংমিশ্রণ, একটি পটবয়েলার।
কী রকম পটবয়েলার? কত রকমের দেশ? আমি যে দুটি টিমের সাথে কাজ করি, সেখানে আমাকে হিসেবে ধরে বারোটা দেশের মানুষ কাজ করে, এর মধ্যে আমাকে নিয়ে চারজন ভারতীয়, তারও মধ্যে একজন নাগরিকত্ব বদলে এখন ডাচ, বাকি তিনজনের মধ্যে, আমাকে ধরে দুজন বাঙালি। আমার টিমে একজন রাশিয়ান আর একজন ইউক্রেনিয়ান একসাথে কাজ করে। তাদের বন্ধুত্ব দেখে বোঝা যায় না, তাদের দুটো দেশ একতরফা ধ্বংসের খেলায় মত্ত। চোখের সামনে স্টেট আর নেশনকে আলাদাভাবে খেলা করতে দেখি। দেখি তারা ছুটির দিনে আমস্টারডামের ড্যাম স্কোয়্যারে মিছিলে যোগ দেয়, ঘর হারানো ইউক্রেনিয়ানদের জন্য ফান্ড-রেইজিং করে।
এটা শুধু আমার টিমগুলোর মধ্যে। তার বাইরে বাকি কোম্পানি জুড়ে যে আরও কত দেশের মানুষ, তাদের কত রকমের ব্যাকগ্রাউন্ড, কত রকমের গল্প তাদের চলে আসার পেছনে, সুযোগ পেলে নির্দোষ কৌতূহল দেখিয়ে শুনি। আমার যিনি কোচ, তিনি জন্মেছেন এবং কিছু বছর থেকেছেন ইজরায়েলে, তারপরে বড় হয়েছেন ইউক্রেনে, এখন নেদারল্যান্ডসে।
মানুষ দেশ ছাড়ে। কত রকমের কারণে। জিজ্ঞেস না করেও বোঝা যায়। জানা যায়। পাকেচক্রে আমার এক ইরানী (তারা নিজেদের বলে পারসিয়ান) সহকর্মীর স্ত্রী-কে দিন কয়েকের জন্য ট্রেনিং দিয়েছিলাম। সেই সময়ে কথায় কথায় জেনেছিলাম, যদিও সবই জানা, তবু একটি পারসিয়ান পরিবারের মুখ থেকে ফার্স্ট হ্যান্ড জানার আলাদা তাৎপর্য থাকে; জেনেছিলাম, ইরানে মেয়েদের কী ধরণের বৈষম্যের শিকার হতে হয়। ঝিকমিকিয়ে ওঠা চোখে একসাথে খেলা করে আনন্দ আর বিষাদ – ইউরোপিয়ান স্বাধীন দেশে কোনও বিধিনিষেধ নেই, ধর্মের, রাষ্ট্রের – মুক্ত জীবন যাপনের আনন্দ, একই সাথে রয়েছে নিজের প্রিয় শহরতলিকে ছেড়ে আসার দুঃখ, মা-বাবা, নিকটজন রয়েছেন সেখানে, বছরে একবারের বেশি যাওয়া হয়ে ওঠে না।
সম্প্রতি আমাদের গ্রুপে জয়েন করেছে একটি ছেলে। আমার টিমে নয়, অন্য টিম, কিন্তু একপ্রকার আমাদের ডিপার্টমেন্টই বলা যায়। চোখমুখের গড়ন দেখে দক্ষিণ ভারতীয় মনে হচ্ছিল, কাছে গিয়ে আলাপ করে জানলাম, তার বাড়ি শ্রীলঙ্কায়। সিন্ধুর টিপ, সিংহল দ্বীপ, কাঞ্চনময় দেশ – দশকের পর দশক ধরে বহু রকমের হিংসা, গৃহযুদ্ধ, বিদেশি শক্তির লোভ সামলাতে সামলাতে ব্যতিব্যস্ত দীনহীন দেশটির উত্তর প্রান্তের একটা গ্রাম, ত্রিঙ্কোমালির খুব কাছে তাদের বাড়ি।
জিজ্ঞেস করা উচিত হবে কি হবে না, সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একদিন তার সাথে বসলাম লাঞ্চ টেবিলে। খানিক ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, আগাম ক্ষমা চেয়ে, দেশে তোমার বাড়ির লোক, তাঁরা কেমন আছেন? তাঁরা কীভাবে বেঁচে আছেন?
কয়েক মুহূর্তের অবিশ্বাসের দৃষ্টি। তার পরে আগল খুলে গেল। ছেলেটি ক্রিশ্চান। শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু। তামিলভাষী। আশির দশকের শেষদিকে জন্ম হয়েছিল রিলিফ ক্যাম্পে। জীবনের প্রথম ছ বছর কেটেছে বিশাল মাঠের মধ্যে প্লাস্টিক আর ত্রিপলের ছাউনির মধ্যে। ততদিনে সরকারি মদতে ঘটানো গণহত্যায় খুন হয়ে গেছেন কয়েক হাজার তামিলভাষী, সংখ্যালঘু সিংহলী। পুরুষ, শিশু, মহিলা। পুলিশের অত্যাচারে, অনাহারে, সরকারী গুণ্ডাদের আক্রমণে। এই ছেলেটি সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কিছু তামিল পরিবারের একজন।
পরে তার বাবা একটি ছোট ব্যবসা চালু করতে সক্ষম হন, তাদের বাড়ি হয়। দুই ভাইয়ের মধ্যে এ ছোটজন। পড়াশোনা করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে এসেছে ইউরোপে, এই কোম্পানিতে জয়েন করে।
বাড়িতে তা হলে এখন কে কে রয়েছেন?
মা নেই। বাবা বুড়ো মানুষ, গ্রামের বাড়িতে রয়েছেন। দাদা থাকে কলম্বোর কাছে। তার চাকরি সেখানে – যদিও কতদিন সে চাকরি থাকবে, কেউ জানে না। দাদা বাবাকে দেখতে যেতে পারছে না – কেন? দাদার কাজের জায়গা তাদের গ্রাম থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরে। পেট্রলের দাম, পেট্রল পাম্পে সাড়ে সাতশো টাকা (সেদিনের রেট, আজ হয় তো আরও অনেক বেশি) প্রতি লিটার। তাও সে পেট্রল পাওয়া যাচ্ছে তিন থেকে পাঁচ দিন লাইনে অপেক্ষা করে। শুরু হয়েছে ব্ল্যাকমার্কেটিং। ব্ল্যাকে পেট্রল বিক্রি হচ্ছে দু হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা প্রতি লিটারে।
কেউ ভাবতে পারে নি এ দিন দেখতে হবে। স্বতস্ফুর্তভাবে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে এই ছেলেটিরই অনেক পরিচিত বন্ধুবান্ধব। পুলিশের লাঠি, টিয়ার গ্যাস খেয়েছে। কিন্তু তার পরেও রাস্তা ছেড়ে নড়ে নি। ছেলেটি, আমার সহকর্মী, অপরাধবোধে চোখ নামিয়ে নেয়, আমি অনেক দূরে, যেতে পারছি না। যেটুকুনি সময় লাইট থাকছে তাদের গ্রামে, তাতে কোনওরকমে মোবাইল চার্জ দেওয়া যাচ্ছে। মোবাইলের টাওয়ারগুলো এখনও কাজ করছে সেখানে। কতদিন করবে, কেউ জানে না।
আরও কতকিছু নিয়ে কথা বললাম। বৌদ্ধদের হিংসার গল্প শুনলাম, ভারতে আরএসএস আর বিজেপির বাড়বাড়ন্ত নিয়ে তার উদ্বেগ সে নির্দ্বিধায় শেয়ার করল আমার সাথে।
আমাদের খাওয়া শেষ হল। আমাদের মিটিংএর সময় হয়ে যাচ্ছে। লিফটের সুইচ টেপার আগে, একবার আমার দিকে তাকিয়ে, একটু ফ্যাকাশে হেসে ছেলেটা বলল, থ্যাঙ্কস। এ দেশে তুমিই প্রথম, যে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করল, আমি কেমন আছি, আমার পরিবারের লোকজন কেমন আছে। এখানে আমার টিমে, কেউ তো জানেই না আমি কোথা থেকে বিলং করি। আমি বলি-ও না। এখানে এখনও সবাই ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত, কোথায় শ্রীলঙ্কা, সেখানে কী অবস্থা, কী চলছে, কেউ জানে না, জানার প্রয়োজনও বোধ করে না।
অনেকদিন বাদে তোমার লেখা পড়লাম। ভালো লাগলো
LikeLiked by 1 person