রাহুল গান্ধী বা তাঁর ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে লিখতে বসে, একটু সমস্যা হচ্ছে এটা ঠিক করতে, যে কোথা থেকে শুরু করব। সবার আগে এটুকু ভেবে রাখাও জরুরি, যে কেনই বা আমি রাহুল গান্ধী বা ভারত জোড়ো যাত্রা নিয়ে লিখতে বসছি? আমাকে বা আমার পলিটিকাল ইনক্লিনেশন সম্বন্ধে যারা জানেন, তারা অবশ্যই আমাকে রাতারাতি কংগ্রেসী বা কংগ্রেস সিমপ্যাথাইজার ভেবে বসবেন না, এটুকু ভরসা আছে। আমাকে কেউ লিখতে বলেও নি, অন্তত সপ্তাহতিনেক আগে থেকে ভাবছিলাম, লিখব, লিখব, কিন্তু স্রেফ লেখার দায় নেই বলেই লিখে উঠছিলাম না। কিন্তু আপাতত, এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, কিছু না লিখলে হয় তো এই সময়টার প্রতি সুবিচার করা হবে না।
সময় বদলে গেছে ভীষণরকম ভাবে। আমার ব্লগ, একদিন আমি শুরু করেছিলাম মূলত ঘোরাঘুরির গল্প লেখার জন্য, আর তার পাশাপাশি রাজনৈতিক লেখাপত্র কিছু রাখার জন্য, নিজের লেখাই হোক বা অন্যের লেখার অনুবাদ। তা, ভ্রমণসঙ্গী সেই মোটরসাইকেল বিক্রি হয়ে গেছে দেড় বছর আগে, এখন আর কোথাও বেড়াতে যেতেও ইচ্ছে করে না। দূর প্রবাসে আমি একা। রাজনীতির লেখাও কমিয়ে দিয়েছি। কমিয়ে কেন, প্রায় বন্ধই করে দিয়েছি লেখা। মাটির সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে রাজনীতি নিয়ে কথা বলার অধিকার অনেকটাই হারিয়ে যায়। আমি সেই যোগাযোগ, সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে ফেলেছি। আমার প্রিভিলেজ আমাকে অন্যদিকে নিয়ে গেছে। বহুকাল হল, নিজে থেকে কিছু লিখি নি আর। তাও, প্রথম দিকে লিখতে মন চাইত, তারপরে গত আট ন’ বছরে, পর পর এতকিছু ঘটে গেছে ভারত নামক আধা-ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রটিতে, কী নিয়ে লিখব, কেনই বা লিখব, ভাবতে ভাবতেই পরের পর শক এসে ভোঁতা করে দিয়ে যায় আমার অনুভূতি। কিছু লেখা আর হয়ে ওঠে না।
উত্তরপ্রদেশ দিল্লি হরিয়ানার বেল্টে ঢোকার আগে রাহুল গান্ধীকে নিয়ে বা তার এই যাত্রাকে নিয়ে মেনস্ট্রিম মিডিয়াতে প্রায় কোনও লেখালিখি হয় নি, সামান্য দু একটা উল্লেখ ছাড়া। মিডিয়ার ঘনত্ব এই ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন বা এনসিআরে অনেক বেশি, তাই এই এলাকার রাডারে চলে আসতেই আপাতত বিভিন্ন মিডিয়ার ওয়েবসাইটে, ইউটিউব চ্যানেলে বা টিভির চ্যানেলে অল্পবিস্তর চর্চা চলছে।
তা হলে আমি বাড়তি কী লিখব? কী হচ্ছে, কী চলছে, সবাইই তো দেখছেন, নিজের নিজের মতন করে মত তৈরি করছেন, বদলাচ্ছেন। আমি কী লিখব? কেনই বা লিখব? আমি কি রাহুলের ওপর বিশাল আশাবাদী? কংগ্রেস পার্টির ওপর? মনে করছি, তারা পরের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে হারাতে পারবে? শেষমেশ কংগ্রেসের ওপর আস্থা রাখছি দিন বদলানোর?
না। একেবারেই না। বিজেপির জনসংযোগ নীতির সঙ্গে যারা অল্পবিস্তর পরিচিত আছেন, তারা সকলেই জানেন, ভারত জোড়ো যাত্রা করে রাতারাতি লোকের মনোভাব বদলে দেওয়া যায় না। সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফলেই তা প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং, আশা বা চিন্তার কিছু নেই, দু হাজার চব্বিশেও আয়েগা তো উনিজী হি।
আমার লেখা নির্বাচনমুখী নয়। আমি লিখতে চাইছি মানুষ রাহুলটাকে নিয়ে।
কন্যাকুমারী থেকে যখন যাত্রা শুরু হল, ৭ই সেপ্টেম্বর ছিল সম্ভবত দিনটা। লক্ষ্য, দেড়শো দিনে তিন হাজার পাঁচশো সত্তর কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কাশ্মীরে গিয়ে যাত্রা শেষ করা। যেহেতু যাত্রাপথ দক্ষিণ থেকে উত্তর, ফলে বেশির ভাগ পশ্চিম এবং পূর্বের রাজ্যগুলোতে এই যাত্রা ঢোকে নি। প্রসঙ্গত, এই যাত্রা অন্তত স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে খুব ইউনিক কিছু নয়। ১৯৮৩ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর, প্রায় একই রাস্তা ধরে একটি ‘ভারত যাত্রা’ করেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে নিজের জনমত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে। সেই যাত্রার শুরু কন্যাকুমারীতে হলেও, শেষ ছিল দিল্লির রাজঘাটে, কিন্তু যাত্রাপথ ছিল আজকের ভারত জোড়ো যাত্রার থেকেও বেশি – চার হাজার দুশো ষাট কিলোমিটার।
শুরুর দিকে ভারত জোড়ো যাত্রার খবর খুব একটা মেনস্ট্রিম মিডিয়াতে থাকত না, তবে ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে যুক্ত থাকার সুবাদে আমি আপডেট পেতাম। হয় তো অনেকেই পেতেন। এবং, এ বিষয়েও সকলেই হয় তো একমত হবেন যে – সেইসব ছোটোখাটো রিপোর্টিং বা ভিডিও ক্লিপগুলি ছিল নিতান্তই বায়াসড, পার্টিজান পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে লেখা বা পোস্ট করা। সে হোক। বায়াসনেসটা ছেঁকে বাকি খবরটুকু দেখলেও এটা বোঝা যাচ্ছিল, যেখান দিয়েই এই যাত্রা গেছে, বেশ ভালোরকমের জনসমর্থন পেয়েছে, রাহুলের পিআর টিমও চমৎকার ক্যান্ডিড সব ফটো তুলেছে বিভিন্ন সময়ে, কখনও বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে, কখনও উচ্ছল যুবতীর নিঃশঙ্কায় রাহুলের হাত ধরে গা ঘেঁষে হাঁটা, কখনো শারীরিক প্রতিবন্ধীর সাথে মানবিকতায় ভরপুর জননেতার ভঙ্গীতে।
ছবিগুলো ভালো। বেশ একটা ফীল-গুড ফ্যাক্টর আসে। তবে, বাস্তব আমাদের বলে অন্য কথা। যারা ভিড় জমায়, তারা সবাই ভোট দেয় না। যারা ভোট দেয়, তারা ভিড় জমায় না।
গত কয়েক বছর ধরে একটা ট্রেন্ড লক্ষ্য করা গেছে সোশাল মিডিয়াতে, আমি নিজেও এই ট্রেন্ডে গা ভাসিয়েছি একটা সময়ে, আশাবাদী সমর্থকদের আশা জাগানোর উপায় হিসেবে জনতার ভিড় দেখানো। এদিকে মহারাষ্ট্রের রাস্তায় লাল ঝাণ্ডা নিয়ে কিষাণদের মিছিল দেখে মনে হচ্ছিল, দিনবদল বুঝি হয়েই গেল, ওদিকে অন্য কোথাও যোগী আদিত্যনাথ বা অমিত শাহর জনসভার ময়দানে গুটিকয়েক লোক, বা ফাঁকা চেয়ারের সারির ছবি দেখিয়ে মীম, খিল্লি। যেন লোক জমা হওয়াই প্রধান পূর্বশর্ত কোনও জননেতার বা কোনও দলের জেতার।
ফ্যাসিস্ট দল ভারতীয় জনতা পার্টির জনসংযোগ সভায় লোক জড়ো করে হয় না। তারা আজকের দিনে সম্পূর্ণ ডিজিটাল। বাকি দলগুলো এই ডিজিটাল জনসংযোগের দৌড়ে বিজেপির থেকে অনেক অনেক পিছিয়ে, তারও একটা মূল কারণ আছে, বিজেপির জনসংযোগ মূলত ভূয়ো খবর বা মিথ্যে প্রোপাগান্ডার ভিত্তিতে হয়। এ পৃথিবীতে মিথ্যে সবচেয়ে দ্রুতগামী। কথাতেই আছে, মিথ্যে ততক্ষণে অর্ধেক পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসে, সত্য যতক্ষণে জুতোর ফিতে বাঁধে।
তো, ভোটে জেতার প্রেক্ষিতে যে ভারত জোড়ো যাত্রা বিশেষ কোনও অবদানই রাখতে পারবে না, সেটা বোঝার জন্য বড় ধুরন্ধর পলিটিকাল অ্যানালিস্ট হবার দরকার পড়ে না, রাহুল নিজেও সেটা জানেন। একাধিকবার প্রশ্ন এসেছে রাহুলের কাছে, রাহুল প্রত্যেকবারই জবাব দিয়েছেন, ভোট লক্ষ্য করে এই যাত্রার পরিকল্পনা করা হয় নি।
আমার লিখতে বসার মূল উদ্দেশ্য ঠিক এই যাত্রাকে গ্লোরিফাই বা রিডিক্যুল করা নয়। করার দায়ও নেই। এই যাত্রা এ মাসেই শেষ হবে, কদিন পরে হয় তো লোকে ভুলে যাবে। আমি আসলে, যত দিন যাচ্ছে, ক্রমশ এই চরিত্রটিকে নিয়ে, রাহুল গান্ধী যার নাম, তাকে নিয়ে আমি ইন্টারেস্টেড হয়ে উঠছি। সময়ের সাথে সাথে তাঁর পরিবর্তন আমাকে বেশ অনুসন্ধিৎসু করে তুলছে।
পাপ্পু। এই নামেই দীর্ঘদিন ধরে তাকে হ্যাটা করা হয়েছে। সংসদের ভেতরে, বাইরে। পলিটিকাল অ্যানালিস্টরা রাহুলের ব্যক্তিত্বে কংগ্রেসকে পুনজ্জীবিত করে তোলার কোনও ক্ষমতা, কোনও আশা দেখতে পান নি। রিলাকট্যান্ট পলিটিশিয়ান। শরীরে অর্ধেক ইটালিয়ান রক্ত, দলের সদস্য, দলের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও যখন খেয়াল ওঠে, উনি ভ্যাকেশনে চলে যান। একাধিকবার কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, পরে আবারও ফিরে বসতে হয়েছে সেই সিংহাসনেই। রাহুলকে সভাপতি রেখে দলের কোনও উন্নতি তো হয়ই নি, বরং পরের পর ভরাডুবি ঘটেছে, অন্তর্দ্বন্দ্ব ক্রমশ প্রকাশ্যে এসেছে। কেউ দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, তো কেউ নিজের পার্টি খোলার চেষ্টা করেছেন। বাকিরা, শতাব্দীপ্রাচীন, এই বনেদী জমিদারীর লিগ্যাসী বয়ে চলা, সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার রাজনৈতিক দলটির অনুগত সেবক হয়ে হাত জোড় করে নাক খত দিয়ে সনিয়া গান্ধী রাহুল গান্ধীরই নিঃশর্ত আনুগত্য ঘোষণা করে গেছেন। এত ভাঙন দেখে, এককালের অনেক সমর্থকই হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন, এবং ঘর সামলাতে ব্যর্থ রাহুলকে মজা করে তারাও ‘পাপ্পু’ বলেই ডেকেছেন।
রাজনৈতিক মার্গদর্শক, বা পলিটিকাল মেন্টর হিসেবে প্রশান্ত কিশোরের সাথে দর কষাকষি চালিয়েছিল কংগ্রেস। সে দর কষাকষি সফল হয় নি, প্রশান্ত নিজেই পরে মিডিয়াকে জানান, যে তাঁর শর্ত মানতে রাজি হন নি কংগ্রেসের নেতৃত্ব। আপাতদৃষ্টিতে প্রশান্ত কিশোরের স্তরের কোনও পলিটিকাল মেন্টর কংগ্রেস দলের আছে বলে আমার জানা নেই, কিন্তু, যত দিন যাচ্ছে, আমার সন্দেহ আরো দানা বাঁধছে, আচরণে এবং ব্যাপ্তিতে এই যাত্রার যে অভিঘাত, যে মেসেজ, সেটা আজ, এই সময়ে দাঁড়িয়ে খুব ক্যালকুলেটেড লাগছে। আর এর আইডিয়া যে স্রেফ রাহুল বা সনিয়া বা কংগ্রেসের কোনও মুখ্য থিঙ্কট্যাঙ্কের মাথা থেকে বেরোয় নি – সেটা খুব সহজেই বোঝা যায়। রাহুল স্রেফ এই যাত্রার মুখ, যে মুখ মেনস্ট্রিম পলিটিক্সে ইতিমধ্যেই পরিত্যক্ত। কিন্তু শূন্য হয়ে যাবার পরেও যেমন কোথাও কোথাও ফিনিক্স পাখির মত জেগে ওঠার সম্ভাবনা দেখা যায়, যা দেখেছি, দেখছি আমরা আমাদের রাজ্যে, ঠিক তেমনি জাতীয় রাজনীতির পরিসরে একেবারে পরিত্যক্ত হয়ে যাবার পরেও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা যায়, সেটা এই সময়ের রাহুলকে দেখে বুঝছি। আর, এইবারের রাহুলের ব্যক্তিত্ব, বক্তব্য, স্ট্র্যাটেজি সম্পূর্ণ আলাদা। পুরোপুরি নতুন। ঠিক ভাবছি না ভুল ভাবছি, সে ভবিষ্যতই বলবে, কিন্তু আমার ভাবনা এটুকুই, এবারের স্ট্র্যাটেজি প্রায় নির্ভুল একটা পথের প্রথম পদক্ষেপ।
বিজেপি বা আরএসএস, আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় বিপদ। শুধু ভোটে জিতে এদের হারানো সম্ভব নয় – এই ন বছরে এটা সকলেই বুঝে গেছে। ঘৃণা, মিথ্যে, অসততায় ভিত্তি করে, এবং গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলোকে ধ্বসিয়ে দিয়ে, দেশের যে ক্ষতি করে ফেলেছে এই উগ্র-দক্ষিণপন্থী শক্তি, এ ক্ষতি সহজে পূরণ হবার নয়। ২০১৪ অবধি আমরা যতটুকু েগোতে পেরেছিলাম, আমরা আজ তার থেকে অন্তত পঞ্চাশ ষাট বছর পিছিয়ে গেছি। একে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা মুখের কথা নয়, স্রেফ ভোটে এদের হারিয়ে এ বিষ নামানো সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে, এদের এমনকি ভোটে হারানোও সম্ভব নয়, সাম্প্রতিক দুটো বিধানসভা আর একটা মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলেই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। হিমাচল প্রদেশ ছাড়া কংগ্রেস কোথাও কিছু করে উঠতে পারে নি, হিমাচলেও এমন মার্জিনে জিতেছে, যে কোনওদিন পয়সা দিয়ে বিধায়ক কিনে এই সরকার ফেলে দেবার ক্ষমতা রাখে বিজেপি। আঞ্চলিক বিকল্প হিসেবে বাকি যে-সব দল উঠে আসছে বা আসার চেষ্টা করছে, তাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু না বলাই ভালো।
ঘৃণার উত্তরে ঘৃণা আসে। আসেই। ইনটলারেন্সকে টলারেট করা টলারেট নয়, ইনটলারেন্স দিয়েই তার মোকাবিলা করতে হয়, কিন্তু সেই ইনটলারেন্সের ভাষা আলাদা হতে হয়। আরএসএসকে সাম্প্রদায়িক দল, বিদ্বেষ ছড়ানো দল, গান্ধীহত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারী দল, এসব অনেকবার বলা হয়ে গেছে। তাতে আরএসএসের ভিত্তি আরও শক্তই হয়েছে। সরাসরি দোষারোপ করে অপরাধী মানসিকতার বিনাশ ঘটানো যায় না। সেটা হয় তো সময়ের সাথে রাহুল ঠেকে শিখেছেন। এইবারের রাহুলকে আমরা দেখছি সেই অন্য ভাষা ব্যবহার করতে। ‘ঘৃণার বাজারে আমি ভালোবাসার দোকান খুলতে এসেছি’। প্রতিটা দিন বিভিন্ন ধরণের বিভিন্ন স্তরের লোকের সাথে মেশা, তাদের কথা শোনা, তাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়া, তাদের আশা দেওয়া – এইবারের রাহুলকে অনেকটা অন্য রকমের মানুষ লাগছে, একটা বড় রকমের ট্র্যান্সফর্মেশন এসেছে। সম্ভবত কারুর কোচিং চলছে। আগেকার উদাসীন, গা-ছাড়া রাহুলের সাথে অনেকটা তফাত তো আছেই, বরং আজকের রাহুলকে দেখে সেদিনের রাহুলের সেই গা-ছাড়া মনোভাবের একটা ব্যাখ্যাও পাওয়া যাচ্ছে।
সর্বভারতীয় কংগ্রেস দলের সভাপতির পদে শেষ পর্যন্ত জেদ ধরে নির্বাচন করিয়ে একজনকে বসাতে পেরেছেন তিনি। আর সেই দায়িত্ব কাঁধ থেকে সরে যাবার পর থেকেই রাহুল যেন অনেকটা হাল্কা। দীর্ঘদিন ধরে এই দায়িত্ব অন্য কাউকে ডেলিগেট করে দেবার পক্ষে সবথেকে বেশি সরব ছিলেন রাহুলই। ভালো কথায় যখন কাজ হয় নি, তখন গোঁ ধরে রিজাইন করে দেওয়া, কংগ্রেসকে হাবুডুবু খেতে দেখেও বাৎসরিক বিদেশভ্রমণে চলে যাওয়া – এ সমস্তই আমরা একাধিকবার দেখেছি। এখন পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, এগুলো সম্ভবত রাহুলকে দিয়ে কেউ করিয়েছেন, একজন পোড় খাওয়া কোচ। তিনি কে, আদৌ কেউ এমন আছেন কিনা, আমি জানি না, হয় তো ভবিষ্যতে জানা যাবে। আমার শুধু এটুকুই সন্দেহ, প্রশান্ত কিশোরের একজন বিকল্প সম্ভবত এসে গেছে। সে সত্যিই বিকল্প কিনা, সেটা ভবিষ্যতের নির্বাচনে বোঝা যাবে।
এবং জনসংযোগ। যার ঠাকুমা এবং বাবা অকালে মারা গেছেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে, রাজীব গান্ধী তো মারা গেছিলেন সিকিওরিটি প্রোটোকল ভেঙে জনতার মাঝখানে গিয়ে অচেনা একটি মেয়ের হাতে বিস্ফোরকবোঝাই মালা পরতে গিয়েই। মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে (১৯৮৪-১৯৯১) দু দুটো খুনের ধাক্কা সামলানো একটা পরিবারের পক্ষে খুব কম কথা নয়। সেই পরিবারের ছেলে হয়ে প্রতিদিন, বার বার অচেনা মানুষজনের সামনে সাধারণ দূরত্ব রেখে, বা কোনও দূরত্ব না রেখে বসা, বাচ্চাদের কোলে তুলে নেওয়া, বড়দের হাতে হাত ধরে চলা, সেলিব্রিটি এবং সাধারণ মানুষ, সকলের সাথেই সমান সম্মান বজায় রেখে কথা বলা, মন দিয়ে তাদের কথা শোনা – এসব করতে খুব, খুব সাঙ্ঘাতিক কলজের জোর লাগে বলে আমার মনে হয়। এই ফ্যাক্টরগুলো স্বাভাবিকভাবে চোখে পড়ে না, কিন্তু এগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
দল হিসেবে কংগ্রেসের প্রতি আমি খুব একটা শ্রদ্ধাশীল নই। কংগ্রেসের অনেক গৌরবময় অতীত আছে, আছে অনেক লজ্জাজনক অতীতও। সোয়া শো বছরের পুরনো একটা জমিদারির লিগ্যাসী বসে চলা সামন্ততান্ত্রিক পার্টির গায়ে বিভিন্ন রকমের দাগ লাগবেই। ইতিহাস সাক্ষী, বেশির ভাগ লজ্জাজনক ঘটনাই ঘটেছে রাহুলের ঠাকুমা ইন্দিরা এবং বাবা রাজীবের হাত দিয়ে। জরুরি অবস্থা, শিখ জেনোসাইড, বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়া, অপরাধীদের অপরাধ জানা সত্ত্বেও তাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে দেওয়া, অন্যায়ের সংখ্যা কম নয়। আবার, ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক দিয়ে ভারতের আর কোনও দল কংগ্রেসের সমকক্ষ নয়। কংগ্রেস দলটিকে নিয়ে বিশেষ কথা খরচ করার কোনও কারণ নেই। একটা প্রাচীনপন্থী দল, বয়েসের ভারে স্বাভাবিকভাবে জর্জরিত, এবং প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। এখন সেই দলকে সেই দলের নেতৃত্ব কীভাবে রিভাইভ করবে, বা আদৌ করবে কিনা, সেটা নেতৃত্বের চিন্তার বিষয়, আমার নয়। কিন্তু আমি যদি কংগ্রেস দলটার থেকে চোখ সরিয়ে স্রেফ ব্যক্তি রাহুল গান্ধীর দিকে তাকাই, আমার মতামত অনেকটা বদলে যায়।
আমি আইকনিজমে বিশ্বাস করি না। ব্যক্তিপূজা পছন্দ করি না। তবু বলব, রাজনৈতিক নেতা রাহুল গান্ধী যতই ফেলিওর হোন, ব্যক্তি রাহুল গান্ধী আমার চোখে একজন অন্যরকমের ব্যক্তি। এবং সনিয়াও। ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এঁরা সাঙ্ঘাতিকভাবে মিসফিট, কিন্তু মানবিক গুণ, বা হিউম্যান ভ্যালুজ-এর দিক থেকে এঁরা অন্য স্তরের মানুষ।
আমরা, ভারতীয়রা, মূলত হিংসার জবাবে প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করি। আমাদের দেশে একজন মহাত্মা গান্ধী জন্মেছিলেন, যিনি অহিংসাকে সারাজীবন সবার ওপরে রেখেছিলেন, যিনি বলেছিলেন চোখের বদলে চোখ একদিন গোটা বিশ্বকে অন্ধ করে দেয়। আমরা তাঁকে জাতির জনক বানিয়েছি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রতিটা কারেন্সি নোটে তাঁর ছবি থাকে, তবু আমরা তাঁর অহিংসাকে আত্মস্থ করতে পারি নি। সেই অহিংসা, ক্ষমা, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়ে গেছেন পর পর দুই বিদেশিনী। একজন গ্ল্যাডিস স্টেইনস, অস্ট্রেলিয়ান ধর্মযাজক গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনসের স্ত্রী। অন্যজন, সনিয়া গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ, রাজীব গান্ধীর স্ত্রী।
ক্ষমার সেই বিশাল রূপের সামনে আমি মুগ্ধ হই বার বার, আমি নতজানু হই। আমার অশ্লীল লাগে নির্ভয়ার মায়ের সেই আকুলিবিকুলি, ধর্ষক অপরাধীদের ফাঁসি দিতে এত দেরি করছে কেন সরকার – আমার অশ্লীল লাগে। রাষ্ট্রের হাতে নাগরিকের হত্যা, সে যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, আমি মেনে নিতে পারি না।
শিন্ডলার্স লিস্ট সিনেমার একটা খুব চরম ইন্টারেস্টিং কনভার্সেশন আছে, ক্ষমার ওপর। আউশউইৎজের নাৎসী অফিসার আমন গোথ আর অস্কার শিন্ডলারের কথোপকথন। পারলে একবার দেখে নেবেন, ইউটিউবে পাওয়া যায়। শাস্তি দেওয়া, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা যার কাছে অনেক সহজ কাজ, তার কাছেই ভীষণ, ভীষণ শক্ত মন থেকে ক্ষমা করে দেওয়া কাউকে, যে তার কোনও চরম ক্ষতি করেছে।
সেই মায়ের ছেলে রাহুল, তার কিছু মানবিক গুণ থাকবেই – সে তো আশা করাই যায়। আজ সকলেই জানেন, নির্ভয়ার একটি ভাই ছিল। সেই ভাইয়ের পড়াশোনা থেকে শুরু করে তার ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সে যোগদান পর্যন্ত সমস্ত পথের খরচা জুগিয়ে গেছেন রাহুল নিজে। নীরবে। তিনি কোনওদিন চান নি এই নিয়ে কোথাও কোনও আলোচনা হোক। আলোচনা হয়েছে অনেক পরে, কিন্তু রাহুল নিজেকে সযত্নে সরিয়ে নিয়েছেন সেইসব আলোচনা থেকে। আমাদের চারপাশে এই ধরণের লোক খুব একটা দেখা যায় না। দেখা গেলেও, তাদের বিশেষ মূল্য থাকে না আমাদের সমাজে। সাধারণত তারা অপরিচিত, ব্রাত্যই থেকে যান।
রাহুলের এ ধরণের একাধিক কীর্তিকাহিনি আছে। সে-সবে যেতে চাইছি না। রাজনীতিতেই ফিরি।
রাহুল কোনওদিনই একজন পোক্ত রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, হয় তো আজও নেই। অন্তত ভারতীয় রাজনীতির নিরিখে আমরা যাকে ‘পোক্ত’ বলি, রাহুল তা নন। তিনি একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতির দায়িত্ব বয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছিলেন, যেটা হয় তো তাঁর নিজের মত করে কংগ্রেসকে বাঁচিয়ে তোলার পরিকল্পনা কিছুতেই সফল হতে দিচ্ছিল না।
এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ রাজনীতিক হওয়া সত্ত্বেও রাহুল সেরকম কিছু পারবেন কিনা, সময় বলবে। আসলে, ভারতের রাজনৈতিক পরিসর এখন যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে, সেখানে রাহুলের মত ব্যক্তিদের বিশেষ কদর নেই, তাঁর নিজের দলেও নেই। দলের লাইনে খেলে আজ পর্যন্ত কোনও কাজ হয় নি, রাহুল এখন নিজের মত খেলতে চাইছেন, যার ছিটেফোঁটা ফলাফল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অবশেষে। জম্মু কাশ্মীরের দলত্যাগী কংগ্রেসি নেতারা আবার দলে ফিরলেন। হয় তো ভবিষ্যতে এরকম আরো কিছু দেখা যাবে।
ভোটে জেতার আগে দেশজোড়া বিজেপি আরএসএসের মতবাদের বিরুদ্ধে জেতা জরুরি। রাহুল সেইখান থেকে শুরু করেছেন। যে লোকগুলো তাঁর চারপাশে রোজ ভিড় করছে, তাদের বেশির ভাগই পরের ভোটেও বিজেপিকেই ভোট দেবে, সেও জানি। এ এক লম্বা অন্ধকার টানেল। ঠিক কতটা হাঁটলে টানেলের শেষে আলো দেখা যাবে, সেটা কেউ জানে না। শুধু ঘৃণার বাজারে ভালোবাসার দোকান খোলার চেষ্টা করে যেতে হবে, আর মানুষকে ক্রমাগত আসল ইস্যুর কথা মনে করিয়ে দিতে হবে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বেসরকারিকরণ, বেরোজগারি, মূল্যবৃদ্ধি। সময়সাপেক্ষ, কিন্তু আমার মতে এইটাই একমাত্র পথ, ঠিক পথ, বিচ্ছিন্নতাবাদী মতবাদের বিরোধিতা সরাসরি না-করে, বিকল্প মতবাদ তুলে ধরা, মানুষকে সেই দিকে আকৃষ্ট করা।
পরিস্থিতি কতদিনে বদলাবে, জানি না। শুধু একটা কথা জানি। প্রচুর চেষ্টা করে, নিজের দেশ থেকে সুবিধেবাদীর মত পালিয়ে গেছি। যদিও ইটালিতে আমার মামার বাড়ি নেই। রাহুলের আছে। যে পরিমাণ ট্রোল, হতাশা, অন্তর্দ্বন্দ্ব রাহুলকে প্রতিদিন সহ্য করতে হয়, দিল্লির চরম দূষণের কথা তো বাদই দিলাম – ‘ধুত্তেরি রইল তোর কংরেস পাটি’ বলে পাকাপাকি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া, বিদেশে গিয়ে সেটলড হওয়া, আমার তুলনায় রাহুলের কাছে অনেক, অনেক বেশি সোজা।
রাহুল সেটা করেন নি। এখনো জমি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে অনেকগুলো পরাজয় নিশ্চিত জেনেও।
এইখানে রাহুল জিতে যান। এই কোয়ালিটিটা, হিপোক্রিট আমি, অল্পস্বল্প অ্যাডমায়ার করি।