বাবরি মসজিদ, আর এক বন্ধুকে হারানোর গল্প

আবদুল্লা খান জন্মসূত্রে বিহারী, এখন মুম্বাইয়ের বাসিন্দা। এ বছর তাঁর লেখা বই আ ম্যান ফ্রম মোতিহারি প্রকাশিত হয়েছে পেঙ্গুইন র‍্যান্ডম হাউস থেকে। সেই বইয়ের একটি অংশ কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছিল দ্য ওয়্যার ম্যাগাজিনে। লেখকের অনুমতিসহ আমি সেই অংশটুকুর বাংলা অনুবাদ আমার ব্লগে রাখলাম, আমার পাঠকদের জন্য।

image-961সময়টা ছিল ১৯৯২ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিক। আমি অরবিন্দের বাড়িতে গিয়েছিলাম ওর কাছ থেকে নেওয়া ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া বইটা ফেরত দিতে। চুপচাপ যখন অরবিন্দের বেডরুমে ঢুকলাম, দেখলাম যে শম্ভুও সেখানে রয়েছে এবং মনে হল অরবিন্দের সাথে কোনও গুরুতর আলোচনার মাঝখানে রয়েছে। বিছানায় ওদের পাশেই একগুচ্ছ বুকলেট পড়ে ছিল; কৌতূহলের বশে আমি তাদের একটা তুলে নিলাম।

দেখতে পেলাম, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী দল, বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্ট পার্টির সভাপতি লালওয়ানি তার মার্কামারা টুথব্রাশ গোঁফ এবং কুৎসিত হাসি নিয়ে প্রচ্ছদে বিরাজমান। ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রস্তাবিত মন্দিরের পাশাপাশি চারশো বছরের পুরানো মসজিদটির ঝাপসা ছবি। প্রচ্ছদের উপরের বাঁদিকে দলীয় প্রতীক ত্রিশূল এবং উপরের ডানদিকে স্লোগান ছিলঃ কসম রাম কি খাতে হ্যায় / মন্দির ওহিঁ বানায়েঙ্গে (রামের নামে শপথ করছি, মন্দির আমরা ওখানেই গড়ব)।

কদিন আগেই স্থানীয় খবরের কাগজের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণের দাবিতে লালওয়ানির আন্দোলনের পরিকল্পনার কথা। নিবন্ধের সাথে ছিল লালওয়ানির বিরক্ত মুখের একটি ক্লোজ-আপ ছবি। খবরটা পড়ে আব্বা মন্তব্য করেছিলেন, ‘এই নেতা প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য হাজার হাজার ভারতীয়কে খুন করবে। মন্দির মসজিদের নামে এ এক রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার পেছনে দৌড়চ্ছে।

শম্ভু আর অরবিন্দ ততক্ষণে খেয়াল করেছে আমার হাতের বুকলেটটা।  ‘আসলাম, প্লিজ বুকলেটটা ফেরত দে। ওটা তোর জন্য নয়,’ খানিক দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায়, আর খানিকটা যেন লজ্জা পেয়ে শম্ভু আমাকে বলল।

‘তো, তোরা এখন তা হলে এইসব শুরু করেছিস’, আমি তেঁতো মুখে বললাম, শম্ভুকে বুকলেটটা ফিরিয়ে দিয়ে।

‘হ্যাঁ করেছি। ইতিহাসে ঘটা সমস্ত ভুলকে ঠিক করা আমাদের কর্তব্য,’ শম্ভু বলল। ‘আর গজনীর মামুদ, বাবর বা ঔরঙ্গজেবের মত মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে যা করেছে, তার জন্য প্রতিটা ভারতীয় মুসলমানের আজ লজ্জা আর দুঃখ প্রকাশ করা উচিত।’

‘আহা! কী যুক্তি! কবেকার কোন মুসলিম রাজাদের ভুল কাজের জন্য আমাকে দায়ী করা যেতে পারে, আর তোরা, উঁচু জাতের ব্রাহ্মণরা, তোদের ঠাকুদ্দা বা তাদের বাবারা নিচু জাতের হিন্দুদের সাথে যা যা করেছিল, সেসবের জন্য তোদের দায়ী করা যায় না। তাই না?’

‘কী বলতে চাইছিস তুই?’ শম্ভু মেজাজ হারাল। অরবিন্দের মুখেও আমি বিরক্তির ছাপ দেখলাম। হয় তো ব্রাহ্মণদের হাতে নিচু জাতের হিন্দুদের প্রতি অত্যাচারের মন্তব্য ওর পছন্দ হয় নি। দেখতে গেলে, ও-ও তো ব্রাহ্মণ। তো, আমি ঠিক করলাম আলোচনার বিষয় পাল্টানোর।

‘আমি স্রেফ এইটুকুই বলতে চাইছি, এই চুতিয়াটাকে সমর্থন করিস না।’ শম্ভুর হাতে ধরা বুকলেটের দিকে আঙুল তুলে আমি বললাম।

‘মুখ সামলে কথা বলবি, আসলাম। লালওয়ানিজী হিন্দু হৃদয় সম্রাট। তুই ওঁর নামে এমন নোংরা কথা বলতে পারিস না।’ ও অনেক কষ্টে রাগ চেপে রেখে কথাগুলো বলছিল। তারপর অরবিন্দের দিকে ফিরে বলল, ‘দ্যাখ অরবিন্দ, ও একজন মহান হিন্দু নেতাকে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে অপমান করছে।’

‘ঠিক। আসলামের ওঁকে চুতিয়া বলা একদমই উচিত হয় নি। ওর উচিত ছিল …’ বলে, একটা লম্বা নাটকীয় দম নিল অরবিন্দ। আমি অরবিন্দের দিকে তাকিয়ে হতাশ হলাম। আমি ভেবেছিলাম ও অন্তত আমার দৃষ্টিভঙ্গীকে সমর্থন করবে।

অরবিন্দ এর পর মুখ খুলল বেশ উত্তেজিত ভঙ্গীতে, ‘ওর উচিত ছিল ওঁকে মহা-চুতিয়া বলা।’

আমার মুখে আলো জ্বলে উঠল, হঠাৎই আমি অরবিন্দের প্রতি এক স্নেহমিশ্রিত কৃতজ্ঞতা অনুভব করলাম।  ওদিকে শম্ভুর মুখ রাগে গনগনে হয়ে উঠল। ‘কী ধরণের ব্রাহ্মণ তুই? তোর মধ্যে তো হিন্দুত্বের ছিটেফোঁটাও নেই,’ শম্ভু প্রায় চীৎকার করে বলল।

‘হ্যাঁ, আমি হিন্দু ক্যাডার নই। আর আমার মধ্যে হিন্দুত্বের পরিমাণ শূন্য। বল্‌ এবার’ অরবিন্দ বলল। হঠাৎ আমি খেয়াল করলাম, ঝগড়া চলছে এখন অরবিন্দ আর শম্ভুর মধ্যে। আমি কিছু না বলে একটু পিছিয়ে গেলাম।

‘মুসলমানের পদবিধারী একটা মছলিখোর ছদ্ম-ব্রাহ্মণের থেকে আর কীই বা আশা করব?’

‘তুই কপালে উল্কি করে লিখে রাখ, যে তুই শান্ডিল্য গোত্রের খাঁটি কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ।’ অরবিন্দ ঠাট্টার সুরে বলল।

‘একশোবার, আমি মহান শান্ডিল্য গোত্রের ব্রাহ্মণ জাত আর আমি তার জন্য গর্বিত। আমরা মাছ-মাংস ছুঁই না, আর আমরা আমাদের আচার বিচার শাস্ত্রে বিশ্বাস রাখি, তোদের মত নই,’ জবাব দিয়েই শম্ভু গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অরবিন্দ বা আমি, কেউই ওকে থামাবার চেষ্টা করলাম না।

ব্রাহ্মণদের মধ্যেও যে বিভিন্ন উপজাত বা গোত্র ভাগ করা আছে, সেটা জেনে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম।

বিছানা থেকে বুকলেটটা তুলে, ছিঁড়ে দু-টুকরো করে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল অরবিন্দ। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘আসলাম, শম্ভুকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা কর। আজকাল ও প্রচুর প্রোপাগান্ডা পড়ছে।’

আমি কিছু বলে ওঠার আগেই অরবিন্দের মা ঘরে ঢুকলেন বাদামভাজা, ঘরে বানানো আলু চিপস, আর তিন কাপ চা সাজানো ট্রে নিয়ে। তাঁর মাঝারি হাইট, ছোট চুল, যা সেই সময়ে আমাদের জগতে সাধারণত দেখা যেত না। আশপাশের অন্যান্য মহিলাদের মত তাঁকে কোনওদিন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে দেখি নি। আমি এক রকম নিশ্চিতই জানতাম যে অরবিন্দ তার উদারনৈতিক মূল্যবোধ তার মায়ের থেকেই পেয়েছে।

‘প্রণাম, চাচী’, আমি মাথা ঝোঁকালাম।

‘ভগবান তোমার মঙ্গল করুন, বেটা,’ একটা টুলের ওপর ট্রে-টা রাখতে রাখতে তিনি বললেন।

‘শম্ভু কোথায়?’ তাঁর প্রশ্নের উত্তরে অরবিন্দ জানাল, ‘ও চলে গেছে’।

******

১৯৯২ সালের এক শীতের বিকেলে, অযোধ্যা শহরে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী পার্টি এবং অন্য কিছু দক্ষিণপন্থী দলের একগুচ্ছ স্বয়ংসেবক উন্মাদের মত বাবরি মসজিদের গম্বুজগুলি গুঁড়িয়ে দেয়। তাদের হাতে ছিল গাঁইতি, হাতুড়ি, বেলচা, লোহার রড। সেগুলো দিয়ে তারা পুরো কাঠামোটিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়।

আমি হতবাক হয়ে গেছিলাম। ভারতের মত দেশে এমন ঘটনা কখনো ঘটতে পারে, আমি ভাবতেও পারি নি। মসজিদ গুঁড়িয়ে দেবার খবর যখন আসে, আব্বাও বিশ্বাস করতে পারে নি, বার বার বলছিল, এটা গুজব। অল ইন্ডিয়া রেডিওর নিউজরিডারের গম্ভীর ব্যারিটোন কন্ঠেও আব্বা বিশ্বাস করে নি।

আব্বার আচরণ আমার অদ্ভূত লাগছিল।

কিন্তু সন্ধেবেলা, নিজের শোবার ঘরে বিবিসি লন্ডনের হিন্দি অনুষ্ঠানে একই খবর শুনতে শুনতে আব্বা হঠাৎই রাগে ফেটে পড়ল, ‘হারামীরা মসজিদ ভেঙে দিয়েছে,’ বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। তারপরে বারবার নিজের কপালে চড় মারতে থাকল।

আমি আব্বার ঠিক পাশটিতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ‘আম্মিই’, বাবার হাত শক্ত করে ধরে আমি চীৎকার করে উঠলাম। আমার মনে হচ্ছিল, আব্বা পাগল হয়ে গেছে।

এক মিনিটের মধ্যেই আম্মি দৌড়ে এল। আব্বাকে কাঁধে বেড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে আমাকে বলল এক গ্লাস জল আনতে।

আমি জল নিয়ে ফিরে এসে দেখলাম, আব্বা বিছানায় শুয়ে আছে। , চোখ বন্ধ, আর আম্মি তার কপালে বাদামী রঙের কিছু একটা মলম লাগাচ্ছিল। তার সাথে সাথে পবিত্র আয়াতও পড়ছিল আর আব্বার মাথায় ফুঁ দিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। আমি শব্দ না করে জলের গ্লাসটা জানলার পাশে রাখলাম, আর আস্তে আস্তে বিছানার পায়ের দিকে গিয়ে বসলাম।

আমার উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে আম্মি আমাকে আশ্বস্ত করল, কাল সকালের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাকে বলল যে আব্বার এর আগেও এই রকমের অ্যাটাক হয়েছিল। অন্তত তিনবার এমন ঘটনা ঘটেছে বলে মনে আছে তার। প্রথম হয়েছিল যখন আব্বার মা হঠাৎ মারা যান। দ্বিতীয়বার হয়, যখন মোতিহারির এক সার্জন ভুল করে আম্মির জরায়ুতে এক সাধারণ সংক্রমণকে ক্যানসারের অ্যাডভান্সড স্টেজ ভেবে বসেছিলেন।

তৃতীয়বার, যখন ১৯৮২ সালের এশিয়ান গেমস হকির ফাইনালে ভারত পাকিস্তানের কাছে ৭-১ গোলে হেরে যায়।

সৌভাগ্যবশত, তিনবারই আব্বা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই সুস্থ হয়ে গেছিল।

আম্মি সেই সন্ধেয় রান্না বসায় নি। 

সেই রাতে, আমি স্বপ্ন দেখলাম ডানাওয়ালা এক অতিপ্রাকৃত জীব মসজিদটাকে ধ্বংস হবার হাত থেকে বাঁচাচ্ছে।

‘ফরিশতা জিব্রায়েল!’ আমি ঘুম ভেঙে চেঁচিয়ে উঠলাম। সারারাত আর ঘুম এল না।

পরদিন সকালে, আব্বাকে আবার ড্রয়িং রুমে বসে খবরের কাগজ পড়তে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম। আব্বার মুখে দুঃখ মাখানো ছিল, কিন্তু নর্মাল ছিল। আমি আব্বাকে সুপ্রভাত জানিয়ে, হাতে টুথব্রাশ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

কয়েক মিনিট বাদে, শম্ভুকে দেখলাম আরও দুটো ছেলের সাথে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে। একবার মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। মুখে চাপা হাসি।

‘বেজন্মা,’ আমি বিড়বিড় করে বাড়ির সামনেই মুখ থেকে ফেনা-ভরা টুথপেস্ট ফেললাম। মনে হচ্ছিল ওখান থেকেই একটা আধলা ইঁট তুলে নিয়ে ওর দিকে ছুঁড়ে মারি। আমি নিশ্চিত ছিলাম ও বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার ঘটনায় প্রচণ্ড উল্লসিত।

বেলার দিকে অরবিন্দ এল আমার সাথে দেখা করতে। ওকে ভীষণ বিচলিত দেখাচ্ছিল।

‘অযোধ্যায় যা ঘটল, তার জন্য আমি মাফ চাইছি, ভাই।’ ও বলল। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল।

আমার খুব অবাক লাগছিল, কারণ একজন হিন্দুর কাছ থেকে এই ধরণের প্রতিক্রিয়া আমি একেবারেই প্রত্যাশা করি নি, অরবিন্দের থেকেও না। আমার মনে বন্ধুর জন্য যেন এক ভালোবাসার ঝড় উঠল। আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। এই ভারতে যদি শম্ভুরা থাকে, তা হলে অরবিন্দরাও আছে। মসজিদ ধ্বংসের খবর পাওয়ার পর থেকেই হিন্দুদের ওপর যে রাগ আর ঘেন্না জন্মাচ্ছিল আমার মনে, তা হঠাৎ যেন অনেকটা কমে গেল।

‘তুই তো ভাঙিস নি রে। তুই কেন মাফ চাইছিস? তুই কেন নিজেকে দোষী মনে করছিস? মুসলমানদের মধ্যেও তো অপরাধী আর ধর্মান্ধ থাকে, কিন্তু তাদের অপরাধের জন্য তো আমি নিজেকে দোষী মনে করি না!’ আমি ওকে বললাম। অরবিন্দ আরও কয়েক ঘন্টা আমার কাছে থেকে তারপর চলে গেল।

সেদিন বিকেলেই, আমি শুনতে পেলাম সরতাজ আনসারি আর আব্বা বাবরি মসজিদ ভাঙার পরবর্তী সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে আলোচনা করছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত জেলা আধিকারিকদের যে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। খবর আসছিল, মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে মুসলিম গ্রুপগুলো জোর করে দোকানদারদের দোকান বন্ধ করতে বাধ্য করছিল, অন্যদিকে দক্ষিণপন্থী হিন্দু গ্রুপগুলো মিষ্টি বিলিয়ে বিজয় দিবস উদ্‌যাপন করছিল।  ‘এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, কিন্তু যে কোনও সময়ে তা খারাপ হতে পারে। হিন্দুরা মুসলমানদের আক্রমণ করতে পারে, কারণ পাকিস্তান আর বাংলাদেশ থেকে মন্দির ভাঙচুরের খবর আসছে,’ সরতাজ আনসারি বললেন।

‘আমাদের সজাগ থাকতে হবে – এটা হিন্দুপ্রধান এলাকা,’ আব্বা উত্তর দিলেন।

আমার মনে হয় না মুখ্যমন্ত্রী বিহারে বাজে কিছু ঘটতে দেবেন। তবুও, সময় থাকতে থাকতে আপাতত কোনও মুসলিম-প্রধান এলাকায় চলে যাওয়াই ভালো।’ সরতাজ আনসারি বললেন, ‘আলে আহমদ আর আজিম খান ওদের পরিবারসমেত খুদা নগর আর মাথিয়া জিরাতে চলে গেছে।’

‘ঠিক বলেছো। আমি ভাবছি আমার পরিবার নিয়ে হামিদপুর চলে যাই, যতক্ষণ না পরিস্থিতি শান্ত হয়,’ আব্বা আবার উত্তর দিলেন, ‘সরতাজ ভাই, তুমিও আমাদের সঙ্গেই চলো না কেন?’

‘দেখুন, রশিদ ভাই,’ সরতাজ আনসারি কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু আব্বা তাঁকে থামিয়ে দিলেন।

‘কোনও কথা শুনছি না। তুমি আর তোমার পরিবার আমাদের সাথে হামিদপুরে আসছো।’

সন্ধের নামাজের পর আমরা হামিদপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। আম্মি, সরতাজ আনসারির স্ত্রী তাঁদের দুই মেয়েকে নিয়ে সরতাজ আনসারির সাদা রঙের মারুতি ওমনির পেছনের সীটে বসলেন। আনসারি ভাই ড্রাইভারের সীটে, আব্বা তাঁর পাশে। ফারুক, নীল রঙের পাঠানি স্যুট আর বাদামী সোয়েটার পরে তার বাজাজ স্কুটারে বসল, আমি বসলাম তার পেছনে।

হামিদপুরের রাস্তায় অস্বাভাবিক কিছু দেখি নি, কেবল কিছু গ্রামের বাড়ির ওপরে গেরুয়া ঝাণ্ডা উড়তে দেখা ছাড়া। আর একটা মুসলিম গ্রামে দেখেছিলাম, হাতে লেখা একটা উর্দু ব্যানার, লেখা ছিলঃ মসজিদ কি শাহাদত কো মত্‌ ভুল জানা (মসজিদের আত্মত্যাগ আমরা ভুলব না)।

রাতের খাবার খেয়ে আমরা আমাদের ঘরে শুতে গেলাম। আম্মা, সরতাজ আনসারির স্ত্রী আর মেয়েরা একটা ঘরে। আব্বা, সরতাজ আনসারি আরেকটা ঘরে।

উলের চাদর জড়িয়ে, হাতে লণ্ঠন নিয়ে আমি ফারুকের সাথে উঠোনের অন্যপ্রান্তে আরেকটা ঘরের দিকে এগোলাম, যেটায় এমনিতে আগে আমি আমার ভাই, ওয়াসিমের সাথে থাকতাম। লন্ঠনটা জানলার ধারে রেখে আমি কম্বলের নিচে সেঁধিয়ে গেলাম। ফারুক মাটিতে একটা মাদুর পেতে নমাজ পড়তে শুরু করল।

আধঘন্টা পরে ফারুক বিছানায় এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মাহরুখের গ্রাম এখান থেকে কদ্দূর রে?’

‘চার কিলোমিটারের কমই হবে হয় তো,’ আমি বললাম।

‘আমরা যাব ওর সঙ্গে দেখা করতে।’

‘আ-আমি যেতে পারব না’। মাহরুখের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা আমাকে প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ফেলে দিল। আমার এক সময়ের অপকর্মের স্মৃতি আরেকবার ফিরে এসে আমাকে বিচলিত করল।

‘কেন?’

‘আব্বাকে না জানিয়ে গেলে আব্বা ভীষণ বকবে।’

‘ঠিক আছে, তুই আমাকে অন্তত এটা কি বলবি ওখানে কীভাবে যেতে হয়? বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নেব।’

‘কিন্তু, তুই কী বলে ওর শ্বশুরবাড়িতে নিজের পরিচয় দিবি?’

‘আরে, বললাম তো, আমি ম্যানেজ করে নেব।’

******

পরদিন সকাল সকাল ফারুক আর আমি বেরিয়ে পড়লাম, আব্বা-আম্মিকে জানালাম, আমরা হামিদপুর ঘুরে দেখতে যাচ্ছি। পায়ে হেঁটে মোহাদ্দিপুর পৌঁছতে প্রায় এক ঘন্টা লাগল। গ্রামের বাইরে একটা চায়ের দোকানে বসে আমরা চা খেলাম, সেখান থেকে বিশ তিরিশ গজ দূরেই সিকরহনা নদী। ফারুক আবারও আমাকে সাথে যাবার জন্য জোরাজুরি করতে লাগল, আর আমিও নানা অজুহাত দেখিয়ে তাকে কাটাবার চেষ্টা করতে থাকলাম।

‘আসলে হয়েছে কী, আব্বা মোহাদ্দিপুরের এক খুব প্রভাবশালী লোকের বিরুদ্ধে কোর্টে কেস লড়ছে। এক টুকরো জমির ডিসপিউট নিয়ে মামলা। আমি যদি এখন ঐ গ্রামে যাই, আব্বার ধারণা, আমার ওপর হামলা হতে পারে। আমি বরং এইখানে এই চায়ের দোকানেই তোর জন্য অপেক্ষা করি, তুই ঘুরে আয়।’

‘ঠিক আছে, আমি দু এক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসব,’ ফারুক বলল।

ফারুক চলে গেল, আমি এক কাপ চা আর দুটো সিঙাড়ার অর্ডার দিলাম। সিঙাড়া এল। মুচমুচে গরম সিঙাড়া কাঁচা আমের চাটনিতে মাখিয়ে আমি খেতে লাগলাম, আর তার স্বাদ ছড়িয়ে পড়তে থাকল আমার সারা মুখে জিভে।

‘এই সিজনে কাঁচা আম কোথায় পেলেন? চাটনিটা তো দারুণ খেতে!’

‘আম শুকিয়ে রেখেছিলাম’, দোকানদার হেসে বলল, আটা মাখতে মাখতে। পাশেই আরেকটা লোক, মনে হল ওর ভাই, জিলিপি ভাজছিল। আমি ধীরেসুস্থে সিঙাড়া শেষ করতে লাগলাম। তারপর নদীর ধারে বালির ওপর পায়চারি করতে করতে আমি ফারুকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

এক ঘন্টা কেটে যাবার পরেও যখন ও ফিরল না, আমার চিন্তা শুরু হল।

মাহরুখের সঙ্গে দেখা করতে ওকে যেতে দেওয়া একদম উচিত হয় নি আমার। ওর বিপদ হতে পারে।

ঠিক করলাম, আমি নিজেই মাহরুখের বাড়ি যাব। আর ঠিক তক্ষুনি, আমি শুনতে পেলাম দূর থেকে ফারুক আমাকে ডাকছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ও সেই চায়ের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে হাত নাড়ছে। আমি প্রায় দৌড়ে গেলাম ওর কাছে।

‘কী হয়েছিল, ফারুক ভাই?’ আমি সতর্কভাবে জিজ্ঞেস করলাম। ওর ঠোঁটে রক্তের দাগ ছিল।

‘আরে তেমন কিছু না’, ফারুক বলল।

‘প্লিজ বল’, আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলাম।

‘মাহরুখের বাড়ি খুঁজে পেতে আমার তেমন সমস্যা হয় নি, কিন্তু ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে আমাকে মিথ্যে বলতে হল, বললাম, আমি সীতামাঢ়ি থেকে ওর এক খুড়তুতো ভাই এসেছি। আমার লম্বা দাড়ি আর সাদা কুর্তা পাজামা দেখে ওরা আমাকে একজন মৌলবী ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছিল। আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি আমায়। ওর শাশুড়ি আমাকে মাহরুখের ঘরে নিয়ে গেল। মাহরুখ তো আমাকে দেখে চমকে গেছিল, আমি ইশারায় ওকে চুপ করতে বললাম। যেই ওর শাশুড়ি আমার জন্য চা-নাশতা আনতে বাইরে গেলেন, অমনি আমি মাহরুখকে বলে ফেললাম যে আমি ওকে এখনও ভালোবাসি আর ওকেই নিকা করতে চাই’, ও বলল।

‘তারপর?’

‘মাহরুখ কিছু বলে ওঠার আগেই ওর ভাইয়েরা এসে পৌঁছল ঐ বাড়িতে। মাহরুখের শাশুড়িই ওদের কাছে খবর পাঠিয়েছিলেন যে ওদের খুড়তুতো ভাই ফারুক এসেছে মাহরুখের সাথে দেখা করতে। আমাকে দেখেই তো ওরা চিনতে পেরে গেছে। মাহরুখের শাশুড়িকে ওরা এতটুকুও বুঝতে দেয় নি, ভাব করছিল যেন আমি সত্যিই ওদের খুড়তুতো ভাই। তারপরে ওরা আমাকে নিয়ে গ্রামের বাইরে এল।’

‘তারপর?’

‘তারপর চড় থাপ্পড় আর লাথি। তারপর আমাকে হুমকি দিল, আর কখনো যদি ওদের বোনের সাথে দেখা করার চেষ্টা করি, আমাকে জানে মেরে দেবে।’

‘ইয়া আল্লা’, আমি বললাম, ‘আমার মনে হয় এইবার তোমার ওকে ভুলে যাওয়া উচিত।’

‘নাঃ, ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। একটা ঠিকঠাক চাকরি পাই, আমি ওকেই নিকা করব, ওর বাবা-মা বা ভাইদের তোয়াক্কা না করে।’

‘তোর বিপিএসসি পরীক্ষা ছিল না এ বছর? কেমন হল?’

‘দিব্যি হয়েছে।’

‘গ্রেট,’ মুখে বললাম, আর মনে মনে ফারুকের সাফল্য প্রার্থনা করলাম।

‘যদি আমি সিভিল সার্ভিস এক্সাম পাস করতে পারি, এ দুনিয়ায় কেউ আমায় মাহরুখকে বিয়ে করার থেকে আটকাতে পারবে না,’ ফারুক বলে চলল, ‘প্রচুর কষ্ট সয়েছে। বেচারি মাহরুখ!’

‘তোর পাঠানো চিঠি আমার মায়ের হাতে কীভাবে পড়েছিল, মাহরুখকে জিজ্ঞেস করেছিলি?’ একটু ইতস্তত করে আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘তোকে বললাম না, আমি কথা বলারই সময় পাই নি। লেকিন ইশক্‌ অউর মুশক্‌ কাঁহা ছুপতা। প্রেম আর আতর কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না। এক দমক হাওয়াতেই ধরা পড়ে যাবে তুই কী লুকোচ্ছিস।’

মাহরুখের সাথে মোতিহারিতে আমি কী করেছিলাম, সেটা আর মাহরুখ ওকে বলে নি দেখে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

মনে মনে আবারও প্রার্থনা করলাম, ফারুক যেন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফল হয়। ফারুক যেন সত্যিই মাহরুখকে নিকাহ্‌ করতে পারে। দুই প্রেমিক-প্রেমিকা এক হতে পারলেই একমাত্র আমার অপরাধের ভার লাঘব হবে।

* * *

আমাদের সমস্ত আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণিত করে মোতিহারি শান্তই রইল। সত্যি বলতে, পুরো বিহার মোটের ওপর শান্তিপূর্ণই ছিল। যদিও ভারতের অন্যান্য অংশ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রভাবে কেঁপে উঠেছিল। দুদিন পরে, আমরা দুটি পরিবারই মোতিহারিতে ফিরে এলাম।

ফেরার পরদিনই, সকালবেলা, আমি আবারও আমাদের বাড়ির বারান্দায় বসে ছিলাম, এবং আবারও শম্ভুকে দেখলাম সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। অরবিন্দের বাড়িতে লালওয়ানিকে নিয়ে সেই তর্কের পর থেকে আমার আর ওর সাথে কথা বলার ইচ্ছে হয় নি।

ঘৃণার রাজনীতির কাছে একজন বন্ধুকে, একজন ভালো বন্ধুকে হারানোর জন্য এক মুহূর্তের জন্য আমার খুব, খুব খারাপ লেগেছিল। কিন্তু আমার কোনও দোষ ছিল না। ও যদি চাইত, আমার কাছে এসে মাফ চাইতে পারত।

————————–

ছবিঃ পিটিআই


মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.