কিছু অসংলগ্ন কথাবার্তা

অনেকদিন, অনেক দিন কিছু লিখি নি। লিখতে আর ইচ্ছে করে না। ব্লগটা বছর বছর পয়সা দিয়ে রিনিউ করাই, নতুন আর কিছু লেখা হয়ে ওঠে না। লিখতে অস্বস্তি হয়, নিজেকে ভণ্ড হিপোক্রিট মনে হয়, খানিক লেখার পরে, ফিরে পড়তে গিয়ে নিজেকেই নোংরা গালাগাল দিই, সব ডিলিট করে ফেলি।

ভ্যালেন্টাইন দিবস গেল। নিজের ছবিতে উনসত্তরটা লাইক, লাভ, উরিব্বাবা – যারা এতদিন আমার ফ্রেন্ড লিস্টে ছিল কিনা সেটাই ভুলে গেছিলাম, তাদেরও লাভ রিয়্যাক্ট পেয়ে বুঝলাম, না, কিছু হার্টবীট তো আছেই আমার চারপাশে। যতই একা লাগুক, যতই ক্লস্ট্রোফোবিক লাগুক, যতই …

থ্রোব্যাকের সাময়িক গল্প শেষ, ফেসবুক বান্ধবীদের চমৎকার ছবিতে আপাত-উইটি কমেন্ট করে বাহবা পাবার শেষে, চোদ্দই ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে এল, পনেরোই ফেব্রুয়ারি। একটা সাধারণ মৃত্যুসংবাদ দিয়ে দিনটা শুরু হল। অটো চালাত। তার কোমরে তাগা বাঁধা ছিল। তার জিনস ফাটা ছিল। গ্র্যাজুয়েট হয়েও সে চাকরি পায় নি সে, এসেছিল প্রতিবাদ জানাতে, একটা দলের তরফে। আর ফিরল না।

দিল্লির বর্ডারে কতজন যেন কৃষক মারা গেছেন গত কমাসে। দুশো পেরিয়ে গেছে কি? আর খবর রাখা হয় না। বিদেশের সুন্দর বরফঘেরা সৌন্দর্যের মধ্যে আমি বসে আছি, পয়সা জমিয়ে সন্তর্পণে ‘দেশে’ এসে ঘুরে যাই, সন্তর্পণে, আমার বাড়ির দেড় কিলোমিটারের মধ্যে চলছে অন্যতম বৃহৎ কৃষক জমায়েত, আমি সেদিকে পা-ও বাড়াই না, মাত্র দেড় মাসের জন্য আসা, কেন এসবে জড়াব নিজেকে? আমি তো হিপোক্রিট।

এমনটা আমি আগের বারেও করেছি। বিদেশ থেকে দিল্লি ফিরেছি, মন আকুলিবিকুলি করা সত্ত্বেও একটিবারের জন্য শাহীন বাগের দিকে পা বাড়াই নি। আমাকে যে ফিরতে হবে, আর দু সপ্তাহ বাদেই ফ্লাইট।

আমি আসলে, খুবই সেলফ-সেন্ট্রিক। নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই বেশি গুরুত্ব দিই না। আমার তাই মইদুল ইসলাম মিদ্যা হওয়া হয়ে উঠবে না। আমি জানিই না আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে কী কী হবে, হতে পারে। আমার তো অনেক বাঁধন, অনেক হিপোক্রিসি।

উইচ হান্টের লিস্টে শেষ নামটা দিশা রবি নামে এক বাইশ বছরের তরুণীর। আমার আত্মজার থেকে ছ বছরের বড়। উইচ হান্টে অনেক আগের দিকে নাম আছে শারজিল ইমাম, দেবাঙ্গনা কলিতা, নাতাশা নারওয়াল, নোদীপ কাউর – আরও কতজনের। আমরা মনে রাখি না। আমি রাখি না। এই যে ছেলেটাকে কদিন আগে ব্যারিকেড টপকে তুলে নিয়ে গেল, হরিয়ানভি অ্যাকসেন্টে কথা বলা সাংবাদিক ছেলেটা – দেখেছেন, নামটাই ভুলে গেছি, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনদীপ পুনিয়া, তাকে ছেড়েও দিয়েছে – কদিন? এক সপ্তাহ মতন রেখেছিল বোধ হয় তাকে পুলিশ কাস্টডিতে।

আচ্ছা, মনদীপ সেদিন মানসিকভাবে তৈরি হয়ে বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে, যে পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করতে পারে? ডিটেন করতে পারে, গুম করে দিতে পারে? প্রথম যখন লাঠি, লাথি, কিলচড়ঘুঁষি এসে পড়ছিল তার ওপর – ওগুলো আমার ওপর হলে আমি কী করতাম? প্রথম থাপ্পড়টা খাবার পর কী কথা মনে আসত?

এই যে মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেল দিল্লি পুলিশ, ব্যাঙ্গালুরু থেকে, দিশা রবি, এ অ্যাক্টিভিস্ট। এ জানত, তার অ্যাক্টিভিজমের জন্য কোনওদিন তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যাবে? মানসিকভাবে তৈরি ছিল? মইদুল ইসলাম মিদ্যা? লাঠি খাবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে এসেছিল নবান্ন অভিযানে?

আচ্ছা, কী কী ভাবে মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া যায়? আমি কি নিতে পারব? কাল যদি সত্যি আমার মাথায় লাঠির বাড়ি পড়ে, কাল যদি সত্যি পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে গিয়ে আমার পেটে পিঠে উপর্যুপরি পুলিশের বুট পরা পায়ের লাথি পড়ে, আমি ঠিক কীভাবে তার মানসিক প্রস্তুতি নেব?

আমি জানি না। আর তাই, ধীরে ধীরে আমি অ্যাকসেপ্ট করে নিই, আমি আসলে হিপোক্রিট। দূর থেকে বিপ্লবের আগুনে হাত সেঁকি। ময়দানে নামার ধক আমার নেই।

ধক কাকে বলে? ধক কীভাবে তৈরি হয়?

“Somebody, after all, had to make a start. What we wrote and said is also believed by many others. They just don’t dare express themselves as we did.”

“কোনো একজনকে তো শুরু করতে হত। আমরা যা লিখেছি আর বলেছি, সে সবে আরো অনেকে বিশ্বাস করেন। তফাৎ এইটুকুই যে তাঁরা সাহস করে বলে উঠতে পারেননি।”

১৯৪৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, মিউনিখে নাৎসিদের তৈরী তথাকথিত জনতার আদালতে বিচারক রোনাল্ড ফ্রেইজলারের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলো বাইশ বছরের ছাত্রী সোফি। সোফি স্কোল।

সোফি ম্যাগডালেনা স্কোল, জন্ম – ১৯২১ সালের ৯ই মে, মৃত্যু – ২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩। গিলোটিনে মারা হয়েছিলো বাইশ বছরের মেয়েটাকে। চরম দেশদ্রোহের দায়ে। কী করেছিল মেয়েটা? ভাই হান্সের সাথে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে যুদ্ধবিরোধী লিফলেট বিলি করেছিল। সেই সময়ের টুলকিট।

অল্প বয়সে বাকি সমস্ত জার্মান ছেলেমেয়েদের মত সোফিও যোগ দিয়েছিল লীগ অফ জার্মান গার্লসে। হান্স যোগ দিয়েছিল হিটলার ইউথে। ধীরে ধীরে দুজনেরই প্রথমদিকের  উৎসাহ সরে গিয়ে তার জায়গায় তৈরি হয় অন্ধ হিটলারভক্তিকে প্রশ্ন করার অভ্যাস, নাৎসী আদর্শের সমালোচনার অভ্যাস। তৈরি হয় ভিন্নমতের জায়গা। জাতিবিদ্বেষ আর যুদ্ধের উন্মাদনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে সোফি আর হান্স। ১৯৪০-৪১ সালে সমমনস্ক আরো কয়েকজনের সঙ্গে হান্স প্যাসিভ রেজিস্টেন্সের রাস্তা নেয় – নাৎসিবিরোধী লেখাপত্র ছাপিয়ে আর বিলি করে। তৈরি হয় হোয়াইট রোজ। যোগ দেয় সোফিও। নানা লেখা আর লিফলেটের মাধ্যমে হোয়াইট রোজ নাৎসি শাসনের পরোক্ষ প্রতিরোধ তৈরির চেষ্টা করতো তারা।

১৯৪২ সালের মে মাসে সোফির বন্ধু ফ্রিৎজ হার্টনাগেল জার্মান বাহিনির সাথে ইস্টার্ন ফ্রন্টে চলে যায়। এই হার্টনাগেলের চিঠি থেকেই সোফি জানতে পারে অপারেশন বারবারোসার সময় সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী আর পূর্ব ইউরোপের ইহুদীদের গণহত্যার কথা – যার সাক্ষী ছিলো হার্টনাগেল নিজেই।

১৯৪২ সালের মাঝামাঝি সময়ে জার্মান সিক্সথ আর্মি স্টালিনগ্রাড আক্রমণ করে। কয়েকমাসের প্রবল যুদ্ধ এবং ক্ষয়ক্ষতির পরে লালফৌজ ঘুরে দাঁড়ায়। সেই বছরের শেষের দিকে সিক্সথ আর্মিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে লাল ফৌজ। প্রায় তিন লক্ষ জার্মান সৈন্য আটকে পড়ে স্টালিনগ্রাড এবং আশেপাশের স্তেপভূমির বরফে। জেনারেল মানস্টাইনের নেতৃত্বে উদ্ধারকারী ফৌজও হেরে ফিরে আসে। আর্মি কম্যান্ডারদের বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও হিটলার সিক্সথ আর্মিকে দেওয়া কোনো অবস্থাতেই পিছিয়ে না আসার নির্দেশ বজায় রাখেন। শেষ বুলেট এবং শেষ সৈন্য অবধি সিক্সথ আর্মিকে স্টালিনগ্রাড ধরে রাখার আদেশ দেওয়া হয়। প্রচন্ড ঠান্ডা, অনাহার, টাইফাস এবং অন্যান্য রোগের আক্রমণে লক্ষ সাধারণ সৈন্য মারা যেতে শুরু করে। অথচ গোটা জার্মানির মানুষকে অবশ্যম্ভাবী জয় সম্পর্কে ভুল বোঝানো হয়।

অবশেষে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আত্মসমর্পণ করেন জেনারেল পাউলাস। ৯১০০০ জার্মান সৈন্য বন্দী হয়। সব মিলিয়ে মারা গেছিল প্রায় তিন লক্ষ বা আরো বেশি সৈন্য। এই আত্মসমর্পণের খবরও হিটলার অস্বীকার করেন। গোয়েবলসের প্রোপাগান্ডা মেশিনের মাধ্যমে জার্মানদের জানানো হয় যে সিক্সথ আর্মি সম্পুর্ণ নিঃশেষ হয়ে গেছে (যদিও যুদ্ধের দুরবস্থার খবর জার্মানরা জানতে পারত ফ্রন্ট থেকে আসা চিঠিপত্রের মধ্যে)। আর এই তিন লক্ষের উপর জার্মান সৈন্যের মৃত্যুকে ব্যবহার করা হয় আরো বড় যুদ্ধের প্রোপাগান্ডায়।

জার্মান সেনাবাহিনীর মধ্যে হিটলারের রাশিয়া আক্রমণ বা ফাইনাল সলিউশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও উঁচুতলার কোনো কম্যান্ডার বিরোধিতার সাহস করেন নি। বরং প্রত্যেকেই পরোক্ষে এইসমস্ত সিদ্ধান্তের শরিক ছিলেন, এবং অধীনস্থ সৈন্যদের সেই মত নির্দেশও দিয়েছিলেন। তুলনামূলকভাবে কমবয়সী কিছু অফিসার বিরোধিতা করলেও তার বেশি কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা এদের ছিলো না। সাধারণ জার্মানরা তো নীরবে নাৎসি শাসন মেনেই নিয়েছিলেন…

স্টালিনগ্রাডের বিপর্যয়ের পর একমাত্র বিরোধিতা দেখা যায় মিউনিখের হোয়াইট রোজ সদস্যদের মধ্যে – এদের কথাবার্তা মিউনিখ থেকে হামবুর্গ, বার্লিন, স্টুটগার্ট ও ভিয়েনায় ছাত্রদের মধ্যে ছড়াতে শুরু করে। ১৯৪৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি, মিউনিখের লুডভিগ-ম্যাক্সিমিলিয়ান ইউনিভার্সিটিতে নাৎসি শাসন ছুঁড়ে ফেলার ডাক দিয়ে লিফলেট বিলি করার সময় গেস্টাপো ধরে ফেলে সোফি, হান্স এবং আরো কয়েকজনকে। দুদিনের মধ্যেই পিপলস কোর্টে এদের সকলের মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হয়। গিলোটিনে মারা যাওয়ার আগে সোফির শেষ কথা ছিলো – “Such a fine, sunny day, and I have to go… What does my death matter, if through us, thousands of people are awakened and stirred to action?”

ধক।

কদিন আগে আ হিডেন লাইফ সিনেমার গল্প লিখেছিলাম।

ধক।

না, নেই। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, চেষ্টা করছি, দেশে যেন আর ফিরতে না হয়। একজন হিপোক্রিট, সেলফ-সেন্টার্ড মাঝবয়েসী লোকের মত আমি আমার ব্যক্তিগত লাভক্ষতির বিবরণকে জাস্টিফাই করছি দেশের পরিস্থিতির নিরিখে।

ঠিক কী কারণে দেশে ফিরব?

শিক্ষাব্যবস্থা? আর ভরসা নেই। আইনশৃঙ্খলা? ভরসা নেই। বিচারব্যবস্থা? ভরসা নেই। সরকার? ভরসা নেই। সুষ্ঠু চিকিৎসাব্যবস্থা? ভরসা নেই। প্রতিবেশি? ভরসা নেই। ভারতের আইটি ইন্ডাস্ট্রির পরিবেশ? ভরসা নেই। ভারতের মিডিয়া? ভরসা নেই। দ্বিতীয় কোনও রোজগারের উপায়? ভরসা নেই। দিন বদলাবার আশা? আশা নেই।

যে দেশটাতে জন্মেছিলাম, সেই দেশটাই আর নেই। অবিশ্যি ছোটবেলা থেকেই একটু একটু করে ‘নেই’ হয়ে যাচ্ছিল, আমরা কেউ টের পাই নি, যারা পাচ্ছিল, তারাও কতটা কী করেছিলেন জানা নেই – গত শতাব্দী সবদিক দিয়েই অন্যরকমের ছিল।

আমি আর দেশে ফেরা ‘সেফ’ মনে করছি না। আমি নিরাপদ মনে করি না আর দেশে ফেরা। কিছুটা বুঝতে পারি যারা নিরুপায় হয়ে অন্য দেশে পালায়, নিজের ঘটিবাটি বেচে ইললিগাল ইমিগ্র্যান্ট হয়ে ঢুকে পড়ে অন্য দেশের সীমানার ভেতরে, একটু ভালো করে বাঁচবার আশায়, আমি তাদের একটু একটু করে বুঝতে পারি।

আমার অবস্থা তাদের মত খারাপ নয়। আমি আমার পালিয়ে যাওয়া নিরাপদে ‘প্ল্যান’ করতে পারি। সময় নিয়ে। নিকটস্থ আত্মজনের ‘সেফ প্যাসেজ’ বানিয়ে ফেলতে পারি। আমি প্রিভিলেজড। এই প্রিভিলেজ টিকিয়ে রাখার লোভ আমাকে হিপোক্রিট করে তোলে। আমাকে স্বার্থপর বানিয়ে তোলে।

আমার আজকাল আর খিদে পায় না। খিদে পাবার আগেই আমি জানি, ফ্রিজের কোথায়, কিচেনের কোন তাকে কী রাখা আছে। আমাকে না খেয়ে থাকতে হয় নি সেভাবে কোনওদিন। অভাব কী, আমি জানি নি। চাকরি না পাবার দুশ্চিন্তা একজন মানুষকে কীভাবে কুরে কুরে খেয়ে ফেলে, আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। কীভাবে পরিস্থিতির সাথে যুঝতে যুঝতে একটা দুটো করে আমার চারদিকের মানুষজন খেঁকুরে হয়ে যান, আমি চেষ্টা করেও ধরতে পারি না।

আমি ভরাপেটে রান্না বসাই। খেয়েদেয়ে ফেসবুক খানিক স্ক্রোল করে, কয়েকটা লাভ আর হাহা রিয়্যাক্ট দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আর তারপরে শেষরাতের দিকে তারা স্বপ্নে আসে।

এই লোকগুলো। যারা আমার মাথাটা বিগেড়েছে একটু একটু করে। যারা চাইলেই দেশ ছাড়তে পারে না, যাদের ইচ্ছে না থাকলেও যুঝতে হয় প্রতিদিন, প্রতিটা ঘন্টা। তারা আমার চিন্তায় আসে। নিজের ওপর আরো ঘেন্না হয়। স্বার্থপর, হিপোক্রিট, লেখা যাবে না এমন নোংরা নোংরা খিস্তি আসে নিজের জন্য। নিজেকেই খিস্তি মারি আধোঘুমে।

মিছিলে যেতে হবে না, সলিডারিটি জানাতে কারুর সমাবেশেও যেতে হবে না, আজকাল তো টুলকিটের ইনফো ঘরে বসে শেয়ার করলেই সিডিশনের কেস লেগে যাচ্ছে। এর পরে নতুন নিয়ম আসছে, ঘরে বসে পানু দেখলেও নাকি পুলিশ তুলে নিয়ে যাবে। অন্য ধর্মে যদি বাইচান্স আমার আত্মজা বিয়ে করে, কথা শোনার আগেই পুলিশ তুলে নিয়ে যাবে লকআপে। বিয়ের সময় অবধি যেতেই হবে না – যদি সিএএ চালু হয়ে যায় এ বছরের শেষের দিকেই, তখন?

হস্টেলে আমরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মহায়ণ পড়তাম। একদিন শ্রীরামচন্দ্র বেড়াচ্ছিলেন বনে, হঠাৎ একটি কাঠপিমড়ে কামড়ালো তাঁর ধনে। ধরায় বিখ্যাত হল দধিচীর ত্যাগ, ঝোলাবিচি কেটে তাঁর হল মানিব্যাগ।

স্ল্যাং। নোংরা কথাবার্তা। প্রথম বাড়ির বাইরে থাকার আনন্দে, প্রথম গালাগাল খুল্লমখুল্লা দিতে শেখার আনন্দে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়তাম এগুলো। কলকাতায় গেলে যমুনা সিনেমার পাশে দাঁড়িয়ে বীফ রোল খেয়েছি কতবার।

কখনো ভাবিই নি, ভাবতে পারি নি এগুলো একদিন ফিসফিস করে বললেও আমাকে রাষ্ট্র তুলে নিয়ে যেতে পারে, ভাবলেও আমাকে লিঞ্চিং করে মেরে ফেলতে পারে। আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আমার প্রিভিলেজ, আমার পদবী, আপার কাস্ট হিন্দু ব্রাহ্মণ, ভরদ্বাজ গোত্র। আমার নাম আখলাক নয়, আমার নাম জুনেইদ খান নয়। আমার নাম মুনাব্বর ফারুকি নয়।

পালিয়ে যাওয়াটাই কি তা হলে আমার ভবিতব্য? কুইট ইন্ডিয়া? আর যাদের সে উপায় নেই?

সাতবার কোম্পানি বদলেছি। আমার বর্তমান চাকরির জায়গা আমার জীবনের আট নম্বর কোম্পানি। নিজের স্কিলের ওপর কনফিডেন্স আছে, এখনও জানি, আমি যদি চাই, এই বয়েসেও আরেকবার চাকরি বদলানো আমার কাছে কোনও ব্যাপার নয়। তার সাথে আরেকটা জিনিস জেনেছি।

কুইটিং ইজ ইজি। ছেড়ে দেওয়া খুব সহজ। পালিয়ে যাওয়া খুব খুব খুউব সহজ। কিন্তু সেটা সলিউশন নয়। তা হলে আমার কাছে সলিউশনটা কী?

আমার দেশ, অফিশিয়ালি হোক বা আনঅফিশিয়ালি, আজ একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র। অনেকদিন আগে থেকেই ছিল, রাখাঢাকা ছিল, এখন খোলাখুলি। ফ্যাসিজমের যা যা নিদর্শন বিজ্ঞজনেরা দেখে লিপিবদ্ধ করে গেছেন, তার সবকটা পয়েন্ট মিলে যায় আজকের ভারতের সাথে। আমি যে কোম্পানিতে চাকরি করি, তার সিইও নিজে ফ্যাসিজমের সমর্থক। মুখে স্বীকার করতে হয় না, কাজেকর্মে বোঝা যায়। প্রতিটা নিদর্শন স্পষ্ট। আমি যে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করি, সেখানে দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিজমপন্থী ছেলেমেয়েদেরই প্রাচুর্য। সবাই কমবেশি প্রিভিলেজড, তারা কেউ দেখতে পায় না, দেখতে চায় না। চাকরি থাকাকালীনও দ্যাখে না, চাকরি চলে গেলেও না। ভারতের যে অঞ্চলে আমি থাকি, সেখানকার কথা আর নতুন করে কীই বা বলব।

কোথায় যাব?

অনেকদিন আগে, কানহাইয়াকে যখন পুলিশ তুলে নিয়ে গেছিল দিল্লি পুলিশ, প্রথম মিছিলে পা মিলিয়েছিলাম। অন্ধ অসহায় রাগে পর পর লিখে ফেলেছিলাম মন কী বাত, দু তিন পর্বে। স্পষ্ট করে লিখেছিলাম, ন্যাশনালিজমের পরিচয়টা আমার কাছে কোনও পরিচয়ই নয় – আমি চাইলেই একটু টাকা আর সময় খরচা করলে ভারতীয় থেকে অস্ট্রেলিয়ান কিংবা কানাডিয়ান হয়ে যেতে পারি।

আজ, পাকেচক্রে আমার কাছে সেই সময়টা এসেছে। যে পরিচয়টাকে আমি গুরুত্বই দিই নি, সেই পরিচয় আমাকে টেনে ধরছে। আমাকে ঘুমোতে দিচ্ছে না। নিজের আইডেনটিটি ঘুচিয়ে ফেলা কি এতই সহজ? ভারতীয় নই বললেই নই হয়ে যাওয়া যায়? এত সুন্দর, এত ভাইব্র্যান্ট, এত কালচারালি রিচ আমার দেশ, আমার চেতনা, আমার স্মৃতি, আমার আত্মপরিচয় – স্রেফ একটা ফ্যাসিস্ট রেজাইমের জন্য আমি অস্বীকার করে ফেলব? নিজেকে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এত সোজা?

আজ আমার সামনে সিদ্ধান্ত নেবার সময়। আমি যে সিদ্ধান্তটাকে নেওয়া এত সহজ মনে করতাম এতদিন, আজ আর কিছুতেই সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। একদিকে সোফি স্কোল, অন্যদিকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। একজন গিলোটিনে শান্তভাবে মাথা পেতে দিয়ে অমর হয়ে গেছেন, আরেকজন পালিয়ে গিয়ে।

আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমার কোন পথটা বেছে নেওয়া উচিত।


এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.