তালেগোলে হরিবোলে, দয়ারা বুগিয়ালেঃ তৃতীয় পর্ব

পর্ব ১ এবং পর্ব ২ -এর পরে …

তখন আমরা সতোপন্থ সামিটে যাচ্ছি। এভারেস্টের উচ্চতা না হলেও এভারেস্টের থেকে কোনও অংশে কম চ্যালেঞ্জিং নয়। সামিটের প্রথম বেস ক্যাম্প পড়ে যোশীমঠে। গারোয়াল রিজিয়নে এইটা একটা মেজর সামিট। এইদিককার সামিটগুলো মূলত আর্মির তরফেই আয়োজন করা হয়। ছজন আর্মির টিম, একজন লেডি মেজরও ছিলেন। আর পোর্টার, শেরপা ইত্যাদি মিলিয়ে মোট তিরিশজনের টিম। আমি ছিলাম হ্যাপ। আমার কাছে আর্মির সার্টিফিকেট আছে – HAP মানে, হাই অলটিট্যুড পোর্টার। অত ওপরে কম অক্সিজেনে আমরা মাল বয়ে ওপরে নিয়ে যাই, খচ্চরদের সঙ্গে।

তিরিশজনের দলের মালও তো কম হয় না, তবু সমস্ত মাল নিয়ে আমরা ওপরে উঠলাম। সতোপন্থ সামিট বেশ ডেঞ্জারাস সামিট, মাঝে ক্রেভাস পড়ে। ক্রেভাস বিভিন্ন সাইজের হয়। ছোটখাটো ক্রেভাসের জন্য আমরা ল্যাডার ইউজ করি। মই বেয়ে এক এক করে পার হওয়া যায়, বড়সড় হলে প্রথমে রোপ বেঁধে চেষ্টা করি, একান্তই না পাওয়া গেলে, সে রাস্তা অ্যাবানডন করে অন্য দিক দিয়ে নতুন রুট খুঁজে বের করতে হয়।

খাড়া চাড়াই, সবার কোমরে ঝুমর বাঁধা থাকে, সেখানে মাউন্টেনিয়ারিং-এর জন্য সমস্ত জিনিস তো বাঁধা থাকেই, আর বাঁধা থাকে রোপ। সবাই একের পর এক বাঁধা থাকে এই দড়ির সাহায্যে – এই দড়িই হচ্ছে আমাদের লাইফলাইন। কখনও কারুর পা ফসকালে রোপ টেনে ধরে তাকে বাঁচানো হয়।

চ্যালেঞ্জিং হলেও, সতোপন্থ সামিট আমরা করে ফেললাম। সামিটে পৌঁছে স্যাটেলাইট ফোনে আর্মি বেসকে খবর দেওয়া হল যোশীমঠে। এবার ফেরার পালা।

যাওয়াটা যত কঠিন, ফেরাটা তার চেয়েও বেশি কঠিন, কারণ প্রথমত একই রাস্তা ধরে ধরে নামা, ফলে একটা একঘেয়েমি এসে যায় বেশির ভাগেরই মনে। তার সাথে একটা ওভারকনফিডেন্স কাজ করে – সামিট হয়ে গেছে মানে আসল কাজ শেষ, চেনা রাস্তাই তো, জাস্ট নেমে গেলেই হল, ফলে ওঠার সময়ে গ্রুপের লোক যতটা সতর্ক থাকে, নামার সময়ে ততটা থাকে না। আর বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে সামিট করে নামার সময়েই। জর্জ হারবার্ট ম্যালোরিও – বিশ্বাস করা হয়, মাউন্ট এভারেস্ট সামিট করে ফেরার পথেই এইভাবে মারা যান, পঁচাত্তর বছর বাদে এই সেদিন যাঁর মৃতদেহ আবিষ্কার হয়েছে। তেনজিং নোরগে আর এডমন্ড হিলারি তো প্রথম লোক যাঁরা এভারেস্ট সামিট করে জীবিত নেমে আসতে পেরেছেন। ম্যালোরি জীবিত নেমে এলে তেনজিংকে আজ আর কেউ চিনত না।

সামিট সেরে নামার মুখে সেটা দ্বিতীয় দিন। আমরা এক জায়গায় বসে খাওয়াদাওয়া করছিলাম। খাবারের কোনও অভাব আমাদের কাছে ছিল না, যথেষ্ট রসদ নিয়েই ওঠা হয়েছিল। আর খেতে বসে একটা ছোট্ট ভুল করে বসলেন মেজর বাত্রা, আমাদের এক্সপিডিশন টিমের একজন ইয়ং সদস্য। বরফের ওপর খেতে বসার সময়ে উনি কোমরের ঝুমর থেকে দড়িটা খুলে নিয়ে হাতে রাখলেন, বসতে অসুবিধা হচ্ছিল নইলে।

দুর্ঘটনাটা ঘটল খাওয়া শেষ করে চলা শুরু হতেই। উনি দড়িটা আর কোমরে বাঁধেন নি, হাতে ধরেই চলছিলেন – সামনেই ছিল একটা তেরছা ক্রেভাস, বরফে ঢাকা ছিল, বাত্রার পা পড়ল সেখানে আর, নিমেষে ক্রেভাসের মধ্যে ঢুকে গেলেন মেজর বাত্রা। দুপুর তখন দুটো। … আমরা ভোররাতে জার্নি শুরু করি, যাতে দিনের আলো থাকতে থাকতে সামিট সেরে নিচে চলে আসা যায়। একবার অন্ধকার হয়ে গেলে এই সব রাস্তা আরও ডেঞ্জারাস হয়ে যায়।

ক্রেভাস, বা পাহাড়ের ফাটলটা একটু নিচে নেমে ইংরেজি এল্‌ শেপে বেঁকে গেছে, বাত্রা সেইখানে আটকে গেছেন। নামবার কোনও রকমের উপায় নেই, আমাদের কাছে যা রোপ আছে, সেটাও নামিয়ে পৌঁছনো যাচ্ছে না বাত্রার কাছে।

দুপুর দুটো থেকে রাত নটা পরযন্ত আমরা চেষ্টা চালিয়ে গেছিলাম। সমানে বাত্রার সঙ্গে কথা হচ্ছে, ওই রকম আটকে থাকা অবস্থায় বাত্রা বলছে তার কথা, তার গ্রামের কথা, তার সন্তানসম্ভবা বউয়ের কথা – সদ্য বিয়ে হয়েছে তাদের, এইসব বলছে আর খালি বলছে, মুঝে বচা লো, মুঝে বচা লো, ম্যায় মরনা নহী চাহতা … আর আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, খাবারের প্যাকেট ছুঁড়ে দিচ্ছি, জল দিচ্ছি, কিন্তু ওকে তুলে আনতে পারছি না। ওর সাথে কথা বলছি, ওকে সাহস জোগাবার চেষ্টা করছি।

কিন্তু হিমালয় একবার যার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে দিয়েছে, তাকে বাঁচায় কার সাধ্য? রাত নটায় স্যাটেলাইট ফোনে আর্মি বেস ক্যাম্প থেকে কল্‌ এল। এ সব ব্যাপারে আর্মির রুল অত্যন্ত কড়া – একজনের জীবন বাঁচাবার জন্য এতজনের জীবন রিস্কে ঠেলে দেবার কোনও মানে হয় না, অ্যাবানডন হিম, তোমরা নেমে এসো নিয়ারেস্ট ক্যাম্পে।

আর্মির হুকুম হল, হুকুম। কারুর অমান্য করবার ক্ষমতা নেই – আর আমরাও জানতাম, এইভাবে এত প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আমরা যতই চেষ্টা করি, আমরা ওকে উদ্ধার করতে পারব না – এত নিচে গিয়ে ও আটকে আছে। কিন্তু কীভাবে ওকে ছেড়ে যাব?

বাত্রা বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল। সে বলছিল, মুঝে পতা হ্যায়, তুমলোগ মুঝে ছোড়কে জা রহে হো, আমাকে ছেড়ে যেও না, আমি এখনও বাচ্চার মুখ দেখি নি, একটু চেষ্টা করো, প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না – আমরা ওকে প্রবোধ দেবার জন্য বলছিলাম, না না, আমরা নিচে যাচ্ছি আরও লম্বা রোপ আনতে, শিকল আনতে, যাতে তোমাকে তুলে আনা যায় – আমরা ফিরে আসব আবার –

বাত্রা বিশ্বাস করে নি। আমরা নেমে আসতে আসতে ওর আর্তনাদ শুনছিলাম, জানি, তোমরা আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো – আমাকে ছেড়ে যেও না, প্লিজ, আমি বেঁচে যাবো – প্লিজ –

এক ঘণ্টা? খুব বেশি হলে দু ঘণ্টা? আমরা চলে আসার পর হয় তো অতক্ষণই বেঁচে থাকবে বাত্রা। ওই হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় অত রাতে কম অক্সিজেনে এর চেয়ে বেশিক্ষণ কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।

আমি এর পর আর কখনও সতোপন্থের রাস্তায় যাই নি। একটা টিম গেছিল বাত্রার ডেডবডি খুঁজে আনতে, পায় নি। সেই ক্রেভাসটা লোকেট করা যায় নি আর।

******************************

আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। প্রেমের ঝুলিতে এমন অনেক অনেক গল্প আছে। আমারই বয়েসী লোকটা প্রচুর সামিট করেছে, প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে, এমন একটা লোক কিনা আমাদের সাথে দয়ারা বুগিয়ালের ট্রেকের দায়িত্বে। এত সুন্দর ব্যবহার, যেন মনে হচ্ছে, আমরা আসলে ওর বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছি।

উত্তরকাশীতে সকাল হল প্রেমের ফোনে। ঝটপট তৈরি হয়ে গেলাম। কাল রাতের সেই ছোট্ট দোকানে গিয়ে আলু পরোটা আর অমলেট খেয়ে পেট ভরালাম। প্রেম এইবারে আমাদের নিয়ে যাবে এন আই এম-এ। নেহরু ইনস্টিট্যুট অফ মাউন্টেনিয়ারিং, উত্তরকাশী। এনআইএম আরও বেশ কয়েক জায়গাতেই আছে, তবে উত্তরকাশীরটা গাড়োয়াল হিমালয়ে ফেমাস, এদিককার বেশির ভাগ পীকের সামিট এক্সপিডিশন এই ইনস্টিট্যুট থেকেই পরিচালিত হয়ে থাকে। আমাদের ছোট্ট ট্রেকের জিনিসপত্রও এখান থেকেই নেওয়া হবে। টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ, আরও কী কী সব লাগে।

আমার গাড়িতে করেই গেলাম এনআইএম। পাহাড়ের মাথায় ঝকঝকে একটা ইনস্টিট্যুট। এখন ছুটি চলছে সেখানে, তাই বিশেষ কেউ নেই। প্রেমের অনুরোধে ওদের মিউজিয়ামটা আমাদের জন্য খুলে দিল, সাথে স্যুভেনির শপও। এদের বিভিন্ন এক্সপিডিশনের ছবি, মাউন্টেনিয়ারিং ইকুইপমেন্টের টুকরোটাকরা জিনিসপত্র, এইসব দিয়েই সাজানো ছোট্ট মিউজিয়াম। পাশেই স্যুভেনির শপ, সেখান থেকে আমরা তিনজনেই কিনলাম এনআইএমের পাজামা, বুনান আর অর্পণ নিল উত্তরকাশীর ম্যাপবই, আমি নিলাম লাহুল স্পিটির ম্যাপবই। এর পরে আমাদের বড় বড় কাপে ঝকাস কফি খাওয়ালো, ক্যান্টিনের পরিচালক নাকি প্রেমের বন্ধু। বেরিয়ে দেখি একটা টাটা সুমোতে সব জিনিসপত্র লোড করা হয়ে গেছে। প্রেম আলাপ করিয়ে দিল আরেকটা ছেলের সাথে – বিজেন্দর। এ হল এনআইএমের কুক, প্রেম নিজেও দারুণ রান্না করে, তবে আমাদের ট্রেকে এবারের কুক হচ্ছে বিজেন্দর।

dsc_0005

আবার ফিরে এলাম হোটেল মন্দাকিনীর সামনে। এখানেই রাস্তার ধারে আমার গাড়ি রাখা থাকবে, আমরা এইবারে এই সুমোতে করে খানিকটা ওপরে যাবো। কাল থেকে শুরু হবে হাঁটা।

dsc_0008

লাগেজপত্র নিয়ে আমরা সুমোতে গিয়ে বসলাম। সুমো ভাগীরথীটা পেরিয়েই বাজারে আমাদের নামিয়ে দিল। বুনান আর অর্পণ বিজেন্দরের সাথে সাথে গেল ইসের দোকানে ইসে কিনতে, আমাকেও পিছু নিতে হল, প্রেম আরও একজনের সাথে গেল সব্জীবাজার করতে। ফাইনালি সাড়ে বারোটার সময়ে আমরা সবাই মিলে আবার গাড়িতে গিয়ে বসলাম। গন্তব্য রায়থাল। উত্তরকাশী থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার ওপরে একটা ছোট্ট গ্রাম। কাল ওখান থেকেই আমাদের ট্রেক শুরু হবে।

dsc_0009

আমাদের সঙ্গে সীটের নিচে জায়গা হল আরও একটি প্রাণীর। প্রেম নিয়ে এসেছে বাজার থেকে। আমাদের আজ রাতের ডিনার।

dsc_0030

গাড়ি উঠতে শুরু করল ভাগীরথীর গা ঘেঁষে। প্রতিটা বাঁকে তার অপরূপ সৌন্দর্য, বিশ্বাসই হয় না এই জলই বয়ে যাচ্ছে এলাহাবার বারাণসী হয়ে আমাদের হুগলি কলকাতায়। স্বচ্ছ অ্যাকোয়া ব্লু রঙের জল পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে নাচতে নাচতে ছুটে চলেছে নিচের দিকে। আড়াই বছর আগে এই জলই আচমকা বেড়ে উঠে ধ্বংস করে দিয়েছিল দুপাশের অসংখ্য গ্রাম। সেখানে এখন গাড়োয়াল ডিজাস্টার রিকভারি প্রজেক্টের সৌজন্যে তৈরি হচ্ছে নতুন উঁচু রিভারবেড। এই এখন আমরা যে রাস্তাটা দিয়ে যাচ্ছি, এটাও আগে ছিল না, বন্যার পরে তৈরি হয়েছে।

dsc_0015

খানিক পরেই ডানদিকে পড়ল একটা ক্যাটক্যাটে লাল হলুদ রঙে রাঙানো আশ্রম, আর তার সামনে কিছু কিম্ভূতকিমাকার মূর্তি। একটা মূর্তি আইডেন্টিফাই করতে পারলাম কালীর মূর্তি বলে। আরেকটা শিবমূর্তি – মাইরি এত অখদ্দে মূর্তি কোনও শিল্পী বানাতে পারে – আমার আগে জানা ছিল না। শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়ার উপমা আগে শুনেছিলাম, এই প্রথম চোখে দেখলাম। এটা পাইলট বাবার আশ্রম।

dsc_1815

আরও খানিক এগিয়ে একটা গঞ্জ এলাকা, গুটিকয় দোকান, একটা এসবিআই এটিএম, সেইখানে গাড়ি থামল। জায়গাটার নাম ভাটওয়ারি। ড্রাইভার, বিজেন্দর, প্রেম আর বাকিরা এখানে একটু চা খাবে। আমরা নেমে একটু এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করে নিলাম। ভাগীরথীর কোনও ভালো ভিউ নেই এখানে, চারদিকে এলোপাথারি দোকানঘর বানিয়ে তুলে জায়গাটার সৌন্দর্যই নষ্ট করে দিয়েছে।

একটু এগিয়ে একটা টি পয়েন্ট। সোজা রাস্তাটা যাচ্ছে রায়থাল, আমাদের গন্তব্যে, ডানদিকের রাস্তাটা যাচ্ছে গঙ্গোত্রী। আরও বাহাত্তর কিলোমিটার দূরে, পুরো গাড়ি চলে এখন গঙ্গোত্রীর রুটে। আর সেই মোড় ছাড়িয়ে আরেকটু ওপরে উঠলে একটু আপাত শান্ত এলাকা একটা ইউ-মোড়। সেইখানে একটা ছোট বাড়ি – দয়ারা ক্রিশ্চিয়ান অ্যাকাডেমি।

পনেরো মিনিট বাদে গাড়ি আমাদের সেইখান থেকে তুলে নিল, আর আধঘন্টা পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম রায়থাল। পাহাড়ের কোলে ছোটমত একটা গ্রাম। খুব বেশি হলে কুড়ি তিরিশটা ঘর, এদিক সেদিক ছড়ানো। চারপাশে ঝকঝক করছে বিভিন্ন বরফের পীক, তার কোনওটার নাম শ্রীকণ্ঠ, কোনওটা বান্দরপুঞ্ছ, কোনওটা গঙ্গোত্রী, একটা পীকের নাম, প্রেম বলল ডিকেডি। ডিকেডি কী? না, দ্রৌপদী কা ডান্ডা। সে আবার কী? হ্যাঁ, কথিত আছে, এই ডান্ডা (মানে এই পীকটা) দিয়ে নাকি দ্রৌপদী রান্না করতেন, মানে কড়াইতে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতেন।

dsc_0028dsc_0039

একটা পীকের নাম প্রেমও বলতে পারল না – বুনান এই সুযোগটা একেবারেই ছাড়ল না, সঙ্গে সঙ্গে নিজের নামে করে নিল পীকটা – মাউন্ট ডিডাব্লুপি।

মুরগী ততক্ষণে ড্রেসড হয়ে গেছে, রান্না শুরু হবার মুখে, জিনিসপত্র নামিয়ে একটা ছোট বাড়িতে ঢোকানো হয়েছে, এখানেই আমাদের রাতের আস্তানা, হোমস্টে। আমরা ক্যামেরা হাতে হাঁটতে বেরোলাম। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সন্ধ্যে নেমে আসছে চারদিকে।

dsc_0040dsc_0042dsc_0043dsc_0046dsc_0048dsc_0049dsc_0050dsc_0051

প্রেম এর মাঝে এক ফাঁকে আমাদের পরের দিনগুলোর প্ল্যান সম্বন্ধে বলতে লাগল। আগামীকাল আমাদের হাঁটা হবে আট কিলোমিটার, গোই বলে একটা ছোট জায়গা পড়ে মাঝে, সেইখানে আমরা কালকের জন্য ক্যাম্প করব, পরের দিন গোই থেকে যাবো দয়ারা বুগিয়াল। আরও ছ কিলোমিটার। তৃতীয় দিন আমরা দয়ারাতেই থাকব, এদিক ওদিক ঘুরব। চতুর্থ দিনে সকালবেলা দয়ারা থেকে শুরু করে একসাথে চোদ্দ কিলোমিটার ট্রেক করে নামব রায়থাল, সেখান থেকে গাড়ি করে সোজা উত্তরকাশী, বিকেলের মধ্যে।

আট কিলোমিটার? প্রথম দিনেই? পারব তো? আইটিনেরারি যা পড়েছিলাম তাতে দৈনিক চার পাঁচ কিমি করে হাঁটার গল্প ছিল। প্রথম দিনেই আট কিলোমিটার?

এই বাড়িটা পাকা রাস্তার একদম শেষে, এর পরেই রাস্তা মোটামুটি শেষ। কাল সকালে এখান থেকেই আমাদের ট্রেক শুরু হবে, আজ সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। বাড়িটা প্রেমের ভায়রাভাইয়ের বাড়ি। মাঝবয়েসী লোকটি আমাদের তিনজনকে দেখে কেমন তটস্থ হয়ে ছিলেন। প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছিল বিজেন্দর, সন্তোষ (প্রেমের ভাগ্নে), ক্রমশ সেটা একটা সময়ে প্রায়-বিরক্তির পর্যায়ে চলে যেতে থাকল।

একটা ঘরে দুটো চওড়া খাট। সেইখানেই আমাদের রাতের শোবার ব্যবস্থা। সাড়ে ছটা নয়, সাড়ে সাতটার সময়ে এসে গেল গরম গরম হাতে গড়া রুটি, ভাত আর মুরগির ঝোল। তার আগে বুনান আর অর্পনের ইসের বোতল খুলে বসার গল্প আলাদা করে আর কীই বা বলার আছে, খানিকক্ষণের জন্য প্রেমও যোগ দিল, কিন্তু ওদের নিজস্ব ব্যবস্থা ছিল পাশের ঘরে, তাই খানিক বাদেই প্রেম চলে গেল। এদিকে আমরা ঘরে ঢোকবার পর থেকেই পাক্কা গুণে গুণে দশ মিনিট অন্তর অন্তর হয় বিজেন্দর, নয় সন্তোষ, নয় প্রেমের ভায়রাভাই, একবার করে দরজা খোলে আর উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করে – কিছু লাগবে কিনা, কিছু দরকার আছে কিনা, কিছু চাই কিনা। প্রথমে কয়েকবার নিরস্ত করবার চেষ্টা করলাম, আপনারা এত ব্যস্ত হবেন না, আমরা তোফা আছি, লেপের নিচে পা ঢুকিয়ে বাংলায় গল্পগাছা করছি, কিন্তু তাতে তারা একেবারেই নিরস্ত হল না। ফ্রিকোয়েন্সিটা ক্রমশ কমতে কমতে সাত আট মিনিটে দাঁড়াল। এ কী মুশকিল! খালি একজন ঢোকে, আর একই প্রশ্ন, আর আমাদের তরফে একই উত্তর।

শেষমেশ দেখলাম, এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবার একটাই উপায়, খেয়েদেয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ো। কিন্তু চাইলেই তো শুয়ে পড়া যায় না, আমাদের এত তাড়াতাড়ি শোবার অভ্যেসই নেই। যাই হোক, খেয়েদেয়ে আরও খানিকক্ষণ অত্যাচার সহ্য করে সাড়ে আটটা নাগাদ আলো নিভিয়ে, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়তেই হল।

বুনান আর অর্পণ পৃথিবীর সুখীতম মানুষ, শোয়ার প্রায় সাথে সাথে ঘুম, অবশ্য ঘুমোবার আগে অর্পণ বার তিনেক স্ট্যাটাস কল সেরে নিয়েছিল, তাতে কী দিয়ে ভাত মেখেছে থেকে শুরু করে কবার বাথরুমে গেছে, সবই বলল বলে মনে হল। আজ আর চাপ নিই নি, ওদের একসাথে একটা খাটে দিয়ে আমি নিজে অন্য খাটে একা শুয়েছি, যদি তাতে আওয়াজের তীব্রতা একটু কমে। আপাদমস্তক মুড়ি দিলাম, ইয়া মোটা লেপ, তাতেও দেখি আওয়াজ ঠিকই কানে ঢুকছে, তবে ওই আর কি, এতদিনে অভ্যেস হয়ে গেছে, খানিক পরে ঘুমিয়েই পড়লাম।

সাড়ে তিনটে নাগাদ ঘুম ভাঙল, ভোরবেলায়। টয়লেট যেতে হবে। বেরোলাম।

সে এক অপূর্ব দৃশ্য। দুদিন আগেই পূর্ণিমা গেছে, আজ দ্বিতীয়া। চরাচর ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়, দূরে ঝকমক করছে বরফের চূড়োগুলো, আর আহা, আজি যত তারা তব আকাশে। লাখে লাখে তারা ঝিকমিক করছে গোটা আকাশ জুড়ে। এই আকাশ তো আমাদের শহর থেকে দেখা যায় না।

ফিরে এসে আর ঘুম এল না, কোনওমতে একটু এপাশ ওপাশ করতে করতে সকাল হয়ে গেল।

সবাই উঠে রেডি হলে আমাদের বেরনো। আজ নাকি আট কিলোমিটার হাঁটতে হবে, গন্তব্য, গোই। দয়ারা যাবার মাঝপথে একটা সমতল জায়গা।


এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.