দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ১৪

আগের পর্বের পর

১লা নভেম্বর, ত্রয়োদশ দিন

সক্কাল সক্কাল ঘুম ভাঙল, যথারীতি। ব্রেকফাস্ট এখানে কমপ্লিমেন্টারি। আগের দিন রাতেই বলে রেখেছিলাম সকাল সাতটায় খাব, কিন্তু রাতের খাবারটা এতই উপাদেয় হয়েছিল যে একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছি। সকালের খাবার কি খাইবার উপায় হইবে?

নিচে নেমে এলাম। একটি মোটাসোটা কালো রঙের ভুটানিজ বেড়াল খুব গম্ভীর মুখে আপন মনে একটানা নিজের বাঁ পায়ের থাবাটি জিভ দিয়ে চেটে বা চুলকে চলেছেন। আমাকে দেখেও বিশেষ পাত্তা দিলেন না। পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলাম মোটরসাইকেলের দিকে। ঠাণ্ডা যে খুব বেশি কিছু আছে এমন নয় – কিন্তু নাথাং ভ্যালির সকালের মতই মোটরসাইকেলের সীটের ওপর বিন্দু বিন্দু শিশিরের ফোঁটারা জমে বরফ হয়ে আছে, সকাল সাড়ে ছটার রোদে তারা ঝিকমিক করছে।

20171101_074201

আজ এমনিতে খুব বেশি যাবার নেই, তবে তাড়াতাড়ি টাইগার্স নেস্ট মনাস্ট্রি হয়ে গেলে পরে থিম্পুটা একবার ঘুরে আসতে পারি। এখান থেকে মাত্রই পঁচিশ তিরিশ কিলোমিটার। কিন্তু শরীর বেশ জানান দিচ্ছে যে, সে ঠিক নেই। তলপেটের ব্যথা আগের দিনের থেকে একটু বেশিই মনে হচ্ছে, উঠতে বা বসতে গেলেই কেমন টান লাগছে ভেতর থেকে। দেখি, কতদূর কী করা যায়।

জেরিক্যানে পেট্রল ছিল, সেইটা ঢেলে ট্যাঙ্ক ভর্তি করে নিলাম, আপাতত আবার ভারতে ফেরা পর্যন্ত আর তেল লাগবে না। দোতলায় উঠে দেখি ব্রেকফাস্টের এলাহি আয়োজন। ব্রেড জ্যাম মাখন কফি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই – জিজ্ঞেস করে একটা মশালা অমলেটও বানিয়ে দিয়ে গেল।

খেতে খেতে অনুপকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করলাম, তৈরি হচ্ছে কিনা জানতে। অনুপ বলল, হ্যাঁ – আমি আর আমার এক বন্ধু, দুজনে মিলে যাবো, পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে নটা মতন বাজবে। তুমিও মোটামুটি ঐ সময়ে চলে এসো – একসাথে হাঁটা যাবে।

অনেকটা সময় আছে – ধীরেসুস্থে ব্রেকফাস্ট শেষ করতে লাগলাম। হোমস্টের ছেলেটি এসে জিজ্ঞেস করল, রাতে খাবো কিনা। তা হলে সন্ধ্যে সাতটার আগে জানিয়ে দিতে হবে। একটু ভেবে দেখলাম, দরকার হবে না। কাল আসার সময়েই দেখে নিয়েছি পারোর মার্কেট এলাকা খুব একটা দূরে নয়। আর যদি ফিরতি পথে থিম্পু যাই – তো সেখানেই ডিনার সেরে একদম ফিরতে পারি, হোমস্টে-তে বসে রাতের খাবার খাওয়ার কোনও মানেই হয় না। অতএব, মানা করে দিলাম।

তৈরি হয়ে, স্নান সেরে ঠিক নটাতে বেরোলাম। হোমস্টে থেকে মাত্র তিন চার কিলোমিটার দূরেই এই মনাস্ট্রি। আসল নাম তাকসাং গোম্পা। তাকসাং (Taktsang) মানেই হচ্ছে বাঘের বাসা – টাইগার্স নেস্ট। অষ্টম শতাব্দীতে গুরু পদ্মসম্ভবের স্মৃতিবিজড়িত এই গুহা। কথিত আছে, এক বাঘিনীর পিঠে চড়ে উড়ন্ত অবস্থায় এই গুরু পদ্মসম্ভব, তিব্বতী ভাষায় যাঁর নাম রিনপোচে – তিনি তিব্বত থেকে এসে পৌঁছন এই গুহার প্রান্তে। এইখানে তিনি, স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী তিন বছর তিন মাস তিন সপ্তাহ তিন দিন … এবং তিন ঘন্টা বুদ্ধের উপাসনা করেন, এবং পুরো উপাসনার সময়কাল সেই বাঘিনী, যা আরেক উপকথা অনুযায়ী গুরু রিনপোচেরই এক ছদ্মবেশী শিষ্যা, এইখানে অবস্থান করতেন। সেই থেকে এই গুহা টাকসাং বা টাইগার্স নেস্ট নামেই খ্যাত, এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বৌদ্ধ পিলগ্রিমেজ। যুগে যুগে বিভিন্ন সমস্যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এখানে আসতেন তপস্যা করার জন্য।

গুহাটি ছিল, কিন্তু মনাস্ট্রি বা গোম্পা (আমরা যাকে গুম্ফা বলি) তৈরি হয় তার অনেক অনেক পরে। সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগে নাগাওয়ন্দ নামগিয়াল, যিনি প্রথম ভুটানকে একটি দেশরাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস শুরু করেন, তিনিই প্রথম এখানে একটি মনাস্ট্রি স্থাপন করার কথা ভাবেন। অবশ্য জীবদ্দশায় তিনি সে মনাস্ট্রি তৈরি দেখে যেতে পারেন নি – এই মনাস্ট্রির জন্য প্রথম ভিত্তিপ্রস্তরটি স্থাপিত হয় সপ্তদশ শতকের একেবারে শেষভাগে। গিয়ালসে তেনজিং রাবগ্যে, ভুটানের তৎকালীন নেতা, ১৬৯২ সালে প্রথম এই মনাস্ট্রি বানাবার কাজ শুরু করেন, জোব চার্নক কলকাতা গ্রামে পা রাখার বছর দুই পরে।

সুপ্রাচীন এই মনাস্ট্রিটি ১৯৯৮ সাল নাগাদ আচমকা এক অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণ পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়, এর পরে ভুটান রাজ-সরকার সুদীর্ঘ প্রচেষ্টায় আবার ধীরে ধীরে ২০০৫ সাল নাগাদ তাকে তার আগের রূপে পুনর্নির্মিত করেন। আজ আমরা যে টাইগার্স নেস্ট দেখি, এটা এই আধুনিক টাইগার্স নেস্টই। গুহাটি অবশ্য পাশেই অবিকৃত আছে।

নটা কুড়িতে পৌঁছে দেখি বেশ বড়সড় এক পার্কিং এরিয়া, সেখানে বেশ কিছু গাড়ি জড়ো হয়ে গেছে, লোকজন যাত্রা শুরু করার তোড়জোড় করছে। বেশির ভাগই কমার্শিয়াল গাড়ি, পশ্চিমবঙ্গ বা ভুটানের নাম্বারপ্লেট সমেত। মোটরসাইকেল এক পাশে পার্ক করে আমি এগিয়ে গেলাম। সঙ্গে পিঠের ব্যাগে কেবল একটি জলের বোতল রেখেছি। নিজেই জানি না পারব কিনা, এর আগে দয়ারা বুগিয়ালের পাঁচ কিলোমিটার চড়তে গিয়ে আমি এক কিলোমিটারও চড়তে পারি নি, ঘোড়া ডাকতে হয়েছিল। তার ওপর শরীর ভালো নেই, থেকে থেকেই পেটের ভেতর কেমন একটা অদ্ভুত টান ধরছে।

অনুপকে ফোন করে জানলাম তারা এখনও তৈরি হয় নি, আসতে আসতে দশটা বাজবে – আমি যেন ওদের জন্য অপেক্ষা না করে এগোতে থাকি। … ভালোই হল, আমি হয় তো পুরোটা উঠতেই পারব না, বা পারলেও খুবই আস্তে আস্তে উঠব, ওদের সাথে তাল মেলানোর ক্ষমতা আমার নেই। মোটরসাইকেলে আমি যতটা সাবলীল, পাহাড়ী পথে পায়ে হাঁটায় আমি ততটাই অক্ষম।

সামনে কয়েকজন ভুটানি বসে লম্বা লম্বা লাঠি বিক্রি করছে – ট্রেকিং স্টিক, পঞ্চাশ টাকা করে। কিনতে গিয়েও ভাবলাম, না, থাক, যদি পারি, নিজের পায়ের জোরেই পারব, লাঠির দরকার হবে না। সামনে কিছু পাহাড়ি খচ্চর নিয়েও লোকজন দাঁড়িয়ে ছিল, আড়াই কিলোমিটারের মধ্যে প্রথম এক কিলোমিটার এরা খচ্চরে চাপিয়ে নিয়ে যাবে, বাকিটা অবশ্য নিজেকেই হাঁটতে হবে। তাদেরও মানা করে দিয়ে আমি এগোলাম। এটা আমার একলা হাঁটা। পারি বা না পারি, স্রেফ নিজের কাছে লেখা থাকবে।

DSC_0306.jpg

প্রথমে কয়েক কদম গাছপালায় ছাওয়া একটা অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা, হাল্কা চড়াই, প্রচুর লোকজন একসাথে বা আলাদা আলাদা গ্রুপ করে হাঁটছে, বয়স্ক লোকজনও আছেন, স্কুলের বাচ্চাদের দলও আছে। কয়েক পা এগিয়েই বুঝলাম, দম কুলোচ্ছে না। দাঁড়ালাম। আশেপাশে খচ্চরওলারা ঘুরঘুর করছে, লাগবে? ঘোড়া লেগা?

না। ঘোড়া খচ্চর লাঠি কিছুই আমি নেব না। দেখি আমার দম আমাকে কোথায় নিয়ে যায়।

গাছে ঢাকা এলাকাটা ছাড়াতে দেখলাম সামনে উঠে গেছে খাড়াই একটা উঁচু পাহাড়, নিচ থেকে সেটার উচ্চতা পঞ্চাশ তলা, ষাট তলা, সত্তর তলা – কি তারও উঁচু কোনও বাড়ির সমান তো হবেই। সেই পাহাড়ের একেবারে মাথায় একটা কানার দিকে, প্রায় যেন ঝুলছে ছোট্ট সাদা একসারি বাড়ি। সেইখানে উঠে পৌঁছতে হবে।

DSC_0309.jpg

শুরু হল আমার হাঁটা। পাঁচ ছ পা হাঁটি, দম পুরো শেষ হয়ে যায়, আর তার পরে পাঁচ থেকে দশ মিনিট বিশ্রাম। একেবারে বুক সমান উঁচু চড়াই রাস্তা। রাস্তা মানে পায়ে চলা পথ, প্রথম এক কিলোমিটার তাও খচ্চরের যাওয়া আসার মতন চওড়া করা আছে, তার পরে হয় তো আরোই সরু রাস্তা হবে।

উঠছি, থামছি, হাঁফাচ্ছি। পাশ দিয়ে লোকজন আমাকে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, কিছু বয়স্ক লোকজন আমার মতই ধীরে ধীরে উঠছেন। কেউ কেউ গাইড নিয়ে এসেছেন, গাইড তাঁদের জলের বোতল, জ্যাকেট, পিঠের ব্যাগ একলা বয়ে নিয়ে চলেছেন, পেছনে পেছনে তাঁরা। পৃথিবীর সমস্ত দেশ থেকে বোধ হয় লোক আসে দৈনিক, এই মনাস্ট্রি দেখতে। চলছেন, থামছে, কাউকে কাউকে দেখলাম এর মধ্যেই নেমেও আসতে। এঁরা কি পুরোটা গেছিলেন? কত সকালে শুরু করেছিলেন?

একটু দূরে দূরে কোথাও জল খাবার জায়গা, কোথাও বসে জিরোবার জায়গা। আমি তখন শেষ শক্তি নিংড়ে ওঠার চেষ্টা করছি। কাল এত ক্লান্ত ছিলাম, কালকেও রাতে পেনকিলার খেতে ভুলেছি, ব্যথাটা এখন রীতিমত সোচ্চারে জানান দিচ্ছে। বসতে গেলেও কষ্ট, উঠতে গেলেও।

বেশ খানিকটা ওঠার পর, ততক্ষণে চারপাশের কিছু মানুষের মুখচেনা হয়ে গেছে, যারা আমার সাথে সাথেই আগেপিছে উঠছেন, কেউ একটু পরে এগিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন, কেউ আমার মতই থেমে থেকে উঠছেন – বেশির ভাগই বয়স্ক লোকজন – এক জায়গায় বসলাম, এক বয়স্কা মহিলা আমার থেকে একটু দূরেই বসলেন। অল্পপরিচিতির হাসি বিনিময় হল, উনি আলাপ করতে বেশ উৎসুক – একা এসেছো?

বললাম, হ্যাঁ। আপনিও একা?

হ্যাঁ, আমিও। তুমি কোথা থেকে এসেছো?

ইন্ডিয়া। ডেলহি। আপনি?

আলাপ এগলো। তিনি এসেছেন ইজরায়েল থেকে। আমি আইটি ফিল্ডে কাজ করি শুনে জানালেন, উনিও আইটি ফিল্ডেই কাজ করেছেন দীর্ঘকাল। কোবোলে প্রোগ্রামিং লিখতেন। তার আগে মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজ। রিটায়ার করে একলা একলা দেশ দেখতে বেরিয়েছেন। বার বার বললেন, ইজরায়েল ইজ আ ভেরি বিউটিফুল কান্ট্রি। অবশ্যই এসো, তোমার ভালো লাগবে।

দীর্ঘশ্বাস মনে চেপে বললাম, নিশ্চয়ই আসব, একদিন নিশ্চয়ই দেখা হবে।

এক কিলোমিটারের মাথায় একটা চাতাল মত এলাকা। কিছু বসার জায়গা। আর ডানদিকে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে একটা ক্যাফেটেরিয়ার দিকে। আমার পেটভর্তি, কিছু খাবার এমনিতে দরকার নেই, তবু দেখি, একটা কোকাকোলার বোতল যদি পাওয়া যায় –

ক্যাফেটেরিয়াটি বেশ বড়সড়। অনেকজনের খাবার জায়গা আছে ভেতরে, বাইরে বসেও খাবার জন্য ছোট ছোট শেড লাগানো, এদিক ওদিক দু একটা স্যুভেনির শপ। কিন্তু দাম শুনে ছিটকে যেতে হল। ছোট কোকের বোতল – যেটা পঁয়ত্রিশ টাকায় পাওয়া যায় ভারতে, সেটার দাম দাবি করছে নব্বই টাকা।

বেরিয়ে এলাম। আমার কাছে যা জল আছে, তাই দিয়েই চলে যাবে।

আবার ওঠা। এবারে রাস্তা আরও খাড়াই। তার মধ্যেই অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েরা কেমন তড়বড় করে বাঁকা রাস্তা না ধরে পাহাড়ের ঘাসপাতা মাড়িয়ে শর্টকাট মেরে ওপরের রাস্তায় উঠে যাচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে উঠছি, থামছি, হাঁফাচ্ছি। চলাটা ধাতস্থ হয়েছে এতক্ষণে, কিন্তু তলপেটের ব্যথা এতটুকু কমে নি, আর দমও বাড়ে নি। চলার থেকে থামতেই হচ্ছে বেশিক্ষণ।

DSC_0321.jpgDSC_0322.jpg

হঠাৎ পেছন থেকে একটা অস্পষ্ট ডাক শুনলাম – সিকিদা, সিকিদা! পেছন ফিরে দেখি, অনুপ এগিয়ে আসছে, সঙ্গে একজন। অনুপ একগাল হেসে বলল, তা হলে আবার দেখা হয়ে গেল, অ্যাঁ?

ম্যাজিকের মত, অনুপের সাথে দেখা হবার পরেই দেখলাম রাস্তাটা প্রায় সমতল হয়ে এল, আর একটু পরেই – সামনে দেখা যাচ্ছে অতল সিঁড়ি, প্রায় হাজারখানেক স্টেপ হবে, নেমে যাচ্ছে পাহাড়ের একদম নিচের দিকে, আর তার পরে আরও শ তিনেক সিঁড়ি উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে মনাস্ট্রির দরজার গোড়ায়। সিঁড়ি যেখানে নেমে শেষ হয়েছে, সেইখানে একটা ছোট্ট পুল, আর তার সামনে বিপুল বেগে নেমে আসছে একটা ঝর্না। ঝর্নার একেবারে ওপরের দিকে একটা গুহা। সেই গুহা, যেখানে পদ্মসম্ভব তপস্যা করেছিলেন। মনাস্ট্রি এখন একেবারে আমার চোখের সামনে, পাহাড়ের কানা বেয়ে ঝুলন্ত।

DSC_0320.jpgDSC_0338.jpgDSC_0341.jpg

সিঁড়ি শুরু হবার মুখে একটা ধাপিতে বসে আছেন সেই ইজরায়েলি মহিলা। আমাকে দেখে আবার একগাল হাসলেন। বললাম, চলুন, বাকিটাও সেরে আসি।

উনি করুণ হাসলেন। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, পরিশ্রান্ত। একটু দম নিয়ে বললেন, নো বাডি, আমার শরীর এর চেয়ে বেশি আর পারমিট করবে না। তোমরা এগোও, যদি পারি, আমি একটু পরে চেষ্টা করছি। না হলে এখান থেকেই ফিরে যাবো। গুড লাক।

সিঁড়িতে পা রাখার আগে একটু ফটোসেশন করে নেওয়া গেল। তেমন কিছু ছবি ওঠে নি, জাস্ট অনুপের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ওর ছবি দিলাম এখানে। সাথে আমারও একটা।

DSC_032620171101_123903.jpg

সিঁড়িতে পা রাখলাম। অতল, অতল সিঁড়ি। তবু, মনে এখন জোর এসে গেছে। পারতেই হবে। পারবই। নামাটা তো অত কষ্টকর নয় – নেমে এলাম, তার পরে আবার শ তিনেকের মত সিঁড়ি উঠতে হবে, মনাস্ট্রিতে যাবার জন্য। আবার হাঁফ ধরে যাওয়া, আবার থামা, জিরনো, আবার ওঠা। অনুপকে বললাম, তোমরা এগোও, আমি আসছি। অনুপ, বোধ হয় কৃতজ্ঞতাবশতই আমার সঙ্গ ছাড়ল না। গুরুদোংমারের রাস্তায় আমি ওকে সাহায্য করেছিলাম, সম্ভবত সেই স্মৃতির ভারেই অনুপ বলল, ঠিক আছে, তুমি চলো, আমি তোমার জন্য দাঁড়াছি।

তা সঙ্গ দিল। টুক টুক করে একসময়ে উঠে পড়লাম টাইগার্স নেস্ট মনাস্ট্রির চাতালে। আকাশে তখন ঘন কালো মেঘ, ইলশেগুঁড়ি শুরু হয়েছে, সাথে হাওয়ার টান। আমার তখন আর কিচ্ছু মাথায় নেই, আমি খালি এটুকু বুঝতে পারছি, আমি পেরেছি। পেট থেকে নিচের দিক অবধি ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ঐ, … এক্সট্যাসি, আমি পেরেছি সত্যি সত্যি, দয়ারা বুগিয়ালের সেই ব্যর্থতার পর এটা আমি সত্যি পেরেছি। হলেই বা মাত্র আড়াই কিলোমিটার, এটুকুই আমার পেরে ওঠা।

অনুপের বন্ধু গেল মনাস্ট্রির ভেতর, আমি আর অনুপ বসে রইলাম বাইরে। একটু বিশ্রাম দরকার। হালকা বৃষ্টির মধ্যে বসে থাকতে দারুণ লাগছিল। কিছু কিছু বৃষ্টি বরফকুচি হয়ে ঝরে পড়ছিল।

বোতলের জল শেষ। আমাদের সামনেই দুজন সিকিওরিটি গার্ড বসে ছিলেন, জিজ্ঞেস করাতে সামনের একটা ছোট থান টাইপের জায়গার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। একটা ছোট গুহামুখ দিয়ে জলের ধারা এসে পড়ছে বাইরে। সামনে কিছু বৌদ্ধ ধর্মগুরুর ছবি রাখা। সিকিওরিটি বললেন, এই জল অত্যন্ত পবিত্র, এটাই খেয়ে নিতে পারো। সবাই খেয়ে যায়।

তবে এক চুমুক জল আঁজলা করে তুলে খেয়ে খুব একটা সুবিধের টেস্ট লাগল না। থাক। নামতে আশা করি অতটা কষ্ট হবে না। বেলা প্রায় তিনটে বাজে। আস্তে আস্তে নিচে নামলাম আবার সিঁড়ি বেয়ে, তার পরে আবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠা। বৃষ্টি বেড়ে আবার কমেও গেল। শেষ সিঁড়ির ধাপে পৌঁছে সেই ইজরায়েলি মহিলাকে আর দেখতে পেলাম না। হয় তো এখান থেকেই ফিরে গেছেন।

ওপরে ওঠার মতই নিচে নামাটাও একই রকমের চ্যালেঞ্জিং। এতটাই খাড়াই রাস্তা, শরীরের ব্যালেন্স রাখতে গিয়ে পায়ের কাফ মাসল টনটন করে যাচ্ছে। তবু শেষমেশ যখন নিচে নেমে এলাম, ঘড়িতে দেখলাম বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। আট ঘন্টা লাগল পাঁচ কিলোমিটার উঠতে এবং নামতে। ছায়ারা দীর্ঘ হয়েছে। নিচে নেমে একবার পেছন ফিরে টাইগার্স নেস্টকে আবার দেখলাম, দূর থেকে।

পার্কিংয়ে গিয়ে মোটরসাইকেলে বসতে গিয়ে টের পেলাম, বসতেও অসুবিধে হচ্ছে। মেন রোড থেকে এক কিলোমিটার ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে এই পার্কিং। প্রতিটা ঝাঁকুনিতে আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল ব্যথা কোথায় এবং কতটা। মেন রোডে পড়বার আগে একটা ছোট রেস্তরাঁ মত, সেইখানে গিয়ে ঢুকলাম আমি, অনুপ আর ওর বন্ধু। সে-ও বোধ হয় কন্নড়, দুজনে অনর্গল নিজেদের ভাষায় কথা বলে যাচ্ছিল – আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পেটপুরে ম্যাগি, কফি আর স্থানীয় ফ্রুট জুস খেলাম। ক্লান্তি খানিক দূর হল।

কাল পারো ছেড়ে, ভুটান ছেড়ে যাবার দিন। এবার ফেরার পালা। কতকিছু দেখতে এসেছিলাম, প্রথমে ফুন্টশোলিংয়ে ছুটি, তার পরে পারমিটের চক্করে পড়ে প্রায় কিছুই দেখা হল না। এখন শরীরের যা অবস্থা, মনে হচ্ছে না থিম্পু পর্যন্ত যেতে পারব। ম্যাগি শেষ করে একটা পেনকিলার খেলাম। থিম্পু থাক। আবার কোনওদিন এলে হবে ’খন।

অনুপকে শেষবারের মত বিদায় জানিয়ে আমি হোমস্টে-র রাস্তা ধরলাম। প্রতিটা ঝাঁকুনিতে সর্বাঙ্গ কুঁকড়ে যাচ্ছে, এত ব্যথা চলছে।

হোমস্টে-তে ঢুকলাম। রাতের খাবার মানা করাই ছিল, আর বললাম না খাবার বানাবার কথা – যেটুকু যা খেয়েছি, একেবারে পেট ভরে আছে, আশা করি রাতটা কেটে যাবে এতে। একেবারে কাল সকালে খাবো। আর ওঠার ক্ষমতা নেই।

কোনও রকমে জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে পড়লাম। তলপেটের যন্ত্রণা এখন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, উল্টোদিকে পেনকিলার তার কাজ শুরু করছে, প্রথমে যন্ত্রণা, ঢেউয়ের মতন আসছে, কমছে, বাড়ছে, কেমন নেশার মত লাগছে। ক্রমশ ঘুম এসে দখল করে নিল সমস্ত চেতনা। এপাশ ওপাশ করতে করতে এক সময়ে ঘুমিয়ে গেলাম।


One thought on “দুই দেশ, ছয় রাজ্য, দুই চাকা, পাঁচ হাজার একশো কিলোমিটার ও এক পাগলঃ পর্ব ১৪

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.